সুইডেনের পথে, ICSE এর সাথে - পর্ব ৩
আমি যে হোস্টেলে উঠেছি সেটা বেশ পরিচিত। হাজার খানেক ৫ তারা পেয়েছে আমার আগের অভিযাত্রীদের থেকে। তো ওখানে ঢুকে নাম ঠিকানা বলে বুকিং অনুসারে রুমের চাবি নিলাম। তার পরেই প্রশ্ন, ইন্টারনেট লাগবে? হু বলতেই একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো যেটায় পাসওয়ার্ড লেখা। পাসওয়ার্ড এর বাংলা করলে দাঁড়ায়, “তুমি অনেক অনেক লক্ষী”। রিসেপশনে যিনি ছিলেন এমনিতেই তার ব্যবহার অসাধারণ। আমিও সুন্দর করে তাই বলে দিলাম, তুমি অনেক অনেক লক্ষী! রুমে ঢুকে দেখি সিস্টেম বেশ মজার। আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিল একটা কাগজে আমার নাম আর কত তারিখে চলে যাবো সেটা লিখে দিয়ে যে রুমে গিয়ে প্রথম কাজ কি হবে। রুমে ১৬টা বিছানা, দুই স্তরে থাক করে। প্রতি বিছানার সাথে একটা সংখ্যা দেয়া, সংখ্যার পাশে ওই কাগজ রাখার জায়গা। সেই একই সংখ্যা লেখা একটা ট্রাংক ও আছে, তালা মারা যায়। যে বিছানা কেউ দখল করতে চায় সে দেখে আগে ওই বিছানায় কেউ আগেই কাগজ দিয়েছে নাকি। না দিলে সে কাগজ রেখে দিলেই অন্যরা বুঝে যাবে এটা দখল করা বিছানা, ওই তারিখ পর্যন্ত। আমিও সুন্দর করে একটা খালি বিছানা দখল করে ফেললাম, সেখানের ট্রাংক এ নিজের লাগেজ রেখে তালাও মেরে দিলাম। আগেই ওরা বিছানার আর কম্বলের চাদর দিয়ে দিয়েছিল, সেগুলো বিছিয়ে রেখে বার হলাম ঘর থেকে। এখানে এসে জানতে পারলাম ওরা নিয়মিত ফ্রী অনুষ্ঠান করে প্রায়ই। যেমন আমি যেদিন গেছি ওইদিনই ওরা বারবিকিউ/গ্রিল পার্টি করবে পার্কে গিয়ে। এরেঞ্জ করে দিবে ওদের স্টাফ, আমরা যে যার পছন্দ তাই ওখানে গ্রিল করতে পারবো। সবাই মিলে গেলাম এক কাঁচাবাজারের দোকানে। হোটেল থেকে বার হয়েই পিছনে ২মিনিটের হাঁটা রাস্তা। যাবার পথে সুন্দর সুন্দর ঝর্ণাওয়ালা ভাস্কর্য। ওখানেই রেলিং দিয়ে পানি জমিয়ে প্রায় ইঞ্চি খানেক পানি জমিয়েছে, বাচ্চারা খেলে সে পানিতে। বেশ সুন্দর ঝিরি ঝিরি বাতাসে ক্লান্তি চলে যায়। যেতে যেতে আলাপ, কে কই থেকে আসছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, ফ্রাঁন্স, জার্মানি - এক এক জায়গার এক এক জন। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে ওরা অবাক! তার উপরে প্রথমবার ইউরোপে, তাও একা! এসব আলাপ করতে করতে কাঁচাবাজারে ঢুকলাম(কাচাবাজার মানে স্বপ্ন জাতীয় বাজার)। সেখানে এক একজন বার্গারের বান, মাংস, সস, সসেজ সহ অনেক কিছু কেনা শুরু করলো। আমি না পারি সুইডিশ পড়তে, না কিছু বুঝতে। ইতিউতি তাকিয়ে ৪পিস মাশরুম দখল করলাম। এরা কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো মাশরুম খাবা খালি? আরো কিছু নাও? আমি উহু বলে লাইনে দাঁড়ালাম - না জানি কত ক্রোনা লাগে এগুলোর জন্য! কোথাও কিছু তো লেখা বুঝি না (পরের দিনই বুঝেছিলাম এগুলো কেমনে পড়তে হয় অবশ্য)। সাথের অস্ট্রেলিয়ান একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই এইগুলা কত ক্রোনা হইতে পারে? সে কি কি জানি হিসাব করে ছো মেরে মাশরুম নিয়ে নিজের প্যাকেটে দিয়ে বললো বেশি হইলে অস্ট্রেলিয়ান এক ডলার, এইটা আমি খাওয়াচ্ছি তোমারে। প্রথম আসছো ইউরোপে। সুযোগ দিলো না আর কিছুই বলার। যাকগে,কেনাকাটা এর পর রওনা দিলাম সবাই পার্কের দিকে।
পার্ক এ হেঁটে যেতে লাগে মিনিট দশেক। হাঁটার সময় একেক জনের সে কি হাসি ঠাট্টা! পার্কে খালি গাছ, ঘাস আর মানুষ। মাঝে পাকা রাস্তা, সেটা দিয়ে মাঝে মাঝে কেউ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে টুং টাং করে বেল বাজাতে বাজাতে। দুই পাশে যেদিকে দু চোখ যায় ঘাস আর বড় গাছ। কোন খানে কেউ উদোম হয়ে রৌদ্রস্নান করছে। কোথাও বা বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে, আর কোথাও বাবা বা মা ট্রলি ঠেলে বাচ্চাদের নিয়ে হাঁটছে। বেশ সুন্দর পরিবেশ। একটু পর পর আবার দেখি সিগালও (বা ওই জাতীয়) উড়ছে। ছোট ছোট লেকও কয়েকটা। হয়তো এজন্যই সিগাল এখানে উড়ে। পৌঁছে এক এক জন তাদের গল্প শুরু করলো। একজন নরওয়ের, দেখতে অনেকটা এভেঞ্জার্সের থরের মতো। সেটা বলতেই সে তড়াক করে উঠে গেল, বললো তুমি জানো থরের কাকে ছাড়া চলেই না? আমি তো মাথা চুলকাচ্ছি .. সুন্দর করে প্যান্ট গুটিয়ে দেখালো - পায়ে ইয়া বড় উল্কি হাল্কের! আরেকজন গল্প করতে করতে জানালো, সে রেসিং করে মোটরসাইকেলের। ছবিও দেখালো, রেসিং করার সময় সে কিভাবে একবার একসিডেন্ট করে ডিগবাজি খেয়েছিল। আবার মজাও করলো, জানো- আমি তো ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে পড়ে আছি। রেস তো চলছে। আমি মনে মনে বিরক্ত হয়ে শুয়ে আছি, ভাবতেছি ধুর - উঠুম না, রেস করে কি হবে। সবাই দৌড়ে আসছে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি ভেবে, হাহাহাহাহা। শুনে আমরাও বলি, হাহাহাহাহা! গল্প চলছে, গ্রীলও চলছে। আমার মাথায় ও টেনশন চলছে। পরের দিন MobileSoft কনফারেন্সে আমার পেপার প্রেজেন্টেশন আছে। কি করবো কেমনে করবো ভাবতে ভাবতেই আরেকজনকে দেখলাম আমাদের কাছে আসতে। ছেলেটাকে হোস্টেলে ল্যাপটপে খুটুর খাতুর করতে দেখলেও এখানে আসতে চায়নি। বলেছিল কি যেন কাজে ব্যস্ত। এখানে এসেও দেখি এপাশ ওপাশ তাকিয়ে আমার মাথা আউলায়ে আছে! বলে লেকের দিকে হাঁটা মারলো। আমি অবশ্য হাসি ঠাট্টা তেমন বুঝতেছিলাম না। কি কি সব মোটরসাইকেল, গ্রেনেড, বন্দুক নিয়ে আলাপ করে এক এক জন। হেঁটে আসতে পারলে হয়তো একটু মাথা ঠান্ডা হবে। কাজেই আমিও রওনা দিলাম লেকের দিকে। (চলবে)