সুইডেনের পথে, ICSE এর সাথে - পর্ব ৪

Written on June 29, 2018

ঘুম থেকে উঠেই তড়াক করে রেডি হতে গেলাম। হিসাব করে দেখলাম খাওয়ার সময় নেই, কারন অপিরিচিত জায়গা, সব বুঝে শুনে উঠতেই সময় চলে যাবে। কনফারেন্স ব্রেকফাস্ট দিবে, কাজেই ওটা নিয়ে বেশি চিন্তা না করলেও চলে। বাসা থেকে ব্লেজার এনেছিলাম, কিন্তু তাপমাত্রার অবস্থা দেখে বুঝলাম ওটা পরে যাওয়া যাবে না, ঘেমে নেয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হবে। সুতরাং শার্ট প্যান্ট পরেই দৌড়।

হোটেল থেকে বার হলাম প্রায় ৭:৩০ এ। খুব একটা ঠান্ডা না বা গরম না, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গরম বাড়বে। আগের লেখাতেই বলেছিলাম, এমন টিকেট কিনেছি যেটা দিয়ে যেখানে খুশি যাওয়া যাবে গোটেবর্গের ভিতরে - সেটা বাস, ট্রাম বা লঞ্চ - যাই হোক না কেন। কিন্তু যাবো কোনদিকে? প্রতি ট্রাম রুটের জন্য একটা সংখ্যা থাকে। ওই রুটের সব ট্রামের গায়ে ওই সংখ্যা লেখা থাকে। তো যেকোন ট্রাম স্টপে রাস্তার দুইধারেই একটা বোর্ডের মতো থাকে, সেখানে বলা থাকে ওই ট্রাম কোন দিকে যাবে। কাজেই যদি হয় ০৬ কোর্টেডলা, এর মানে এটা এই স্টপ থেকে কর্টেডলার দিকে যাবে, আর যদি উল্টো দিকে লেখা থাকে ০৬ লেনসমেন্সগতন, ওটা লেনসমেন্সগতন এর দিকেই যাবে! যাই হোক, ট্রামে উঠে সময় মতন পৌঁছালাম গথিয়া টাওয়ারে। মোবাইলসফট এর ভেন্যুতে পৌঁছে দেখি খালি তিন জন আছেন। ক্রিস্টিন, ডেনিস আর একজন স্টাফ। একজন জেনারেল চেয়ার , আরেকজন মোবাইলসফট কনফারেন্স এর কিনোট স্পিকার। এরা দুইজন প্রায় এক ঘন্টা আগে উপস্থিত হয়েছেন সব ঠিক আছে নাকি দেখতে আর মানসিক প্রস্তুতি নিতে। প্রথমজনকে আমি চিনতাম না, কিন্তু অস্থির চালচলন, লাফালাফি করে আমার সাথে পরিচিত হওয়া দেখে আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়েছিলাম। পরে ইনার কাজের বাহার দেখে আর প্রশ্ন করার ধরন শুনে বুঝে গেছি উনি কি বস্তু। একটু পরে তাঁরা চলে গেলে আরেকজন আসলেন, প্রায় ছয় ফুট লম্বা, শুকনো করে কিন্তু চেহারায় হাসি লেগেই আছে। পরিচিত হতে বললেন ওহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? আমি চিনি তোমাদের কয়জনকে। যদিও ওরা মনে হয় আর ঢাবিতে জয়েন করেনি। আমাকে একজনের নামও বললেন ঢাবি সিএসই এর, তবে উনাকে আমি চিনতে পারিনি। পরে জিজ্ঞাসা করে জানলাম উনিও প্রফেসর, নাম ক্রিস্টোফ। বড় কনফারেন্সের মজাই এইটা। দুনিয়ার জাঁদরেল সব প্রফেসর আপনার সামনের হাহাহিহি করে ঘুরে বেড়াবে, আপনি বুঝবেনও না এদের মাথায় কি অসম্ভব জটিল চিন্তা আর গবেষণা খেলা করে। যাই হোক, উনার প্রেজেন্টেশন পরের দিন, কিন্তু উনি আগের দিন এসেছেন চেক করতে - স্টেজ কেমন, মাইক কিভাবে ব্যবহার করে এখানে, মাইক থেকে দূরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করা লাগে নাকি এইসব খুঁটিনাটি। শুনে মনে মনে একটু খুশি হলাম, আমার ছাত্রদের প্রায়ই বলি, Excellence মানে বেশি না, ৫%। এটার মানে কি, যারা অসাধারন কাজ করেন, আর যারা ভালো কাজ করেন তাদের মধ্যে কাজে খুব বেশি হলে ৫% পার্থক্য হয়। কিন্তু ওই ৫% টার জন্য খুঁটিনাটি দেখা লাগে। ওটাই পার্থক্য গড়ে দেয়।

তো ক্রিস্টোফ প্রেজেন্টেশন চেক করে দেখছেন প্রজেক্টরে, রঙ ঠিক মতো আসে নাকি ইত্যাদি - ওইসময় আমি বলে বসলাম, সব তো স্পয়লার দিয়ে দিচ্ছ। আমি দেখে ফেলতেছি কিন্তু। ক্রিস্টোফ দুম করে বলে দিলো, দেখো দেখো ভালো করেই দেখো - কালকে তুমি আমাকে কঠিন কঠিন প্রশ্ন না করলে তোমার কপালে খারাবি আছে। আমি তো অবাক, বলে কি? আমাদের এখানে তো পোলাপানরা প্রশ্ন না করলে বেঁচে যায়, আর এই প্রফেসর দেখি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার জন্য আমাকে বুকিং দিচ্ছে!

একটু বলে রাখি, বাইরে আসলে প্রশ্ন উত্তর অনেক গুরুত্ত্বের সাথে দেখা হয়। আপনি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে আপনি জানেন, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে হয়তো সেই আঙ্গিকে চিন্তা করেন নি, বা হয়তো সেটা আপনার কাজের দুর্বলতা। কাজেই ওই প্রশ্নের কারণে আপনি দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে, বা সেই নতুন আঙ্গিকে চিন্তা করতে পারছেন। এটা কিন্তু খুব, খুব দরকার নিজের কাজ ভালো করতে। আলাপ করতে করতে বললাম আমরা সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাত্র পড়াশুনা শুরু করেছি, আমি এসেছি প্রথমবার মোবাইলসফট এ। ছোটবেলায় যাদের খালি ছবি দেখেছি আর পেপার পড়েছি তারা আমার কাজ দেখবে। সব মিলিয়ে নার্ভাস লাগছে। সে বলে, এটা ব্যাপার না - একবার এসেছ যখন বার বার আসবে এখন। আর উনি নিজে প্রথম প্রথম ICSE তে আসতেন স্টুডেন্ট ভলান্টিয়ার হিসেবে, যেন শুনে শুনে শিখতে পারেন। এখন তো একাডেমিয়ার লাইনেই চলে এসেছেন। যাই হোক, প্রেজেন্টেশন একটু পরে শুরু হলো। সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করবো না, সমগ্র পাঠক সমাজের ওগুলো হজম হবে না। সারসংক্ষেপে বৈশিষ্ট্যগুলো গুলো বলি -

  • কনফারেন্স এ গেলে লেটেস্ট এন্ড গ্রেটেস্ট কাজ সম্পর্কে জানা যায় তো অবশ্যই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জানা যায় সামনে কি কি আসছে এটা নিয়ে আলাপ
  • ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিক কোলাবরেশন ওখানে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়
  • প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে কোন ছাড় নাই। প্যানেল ডিসকাশন এর সময় Android Studio না xcode, iOS না Android জাতীয় খুচরা আলাপ এর সময় অডিয়েন্স থেকে একজন মুখের উপর বলে দিয়েছিল - গ্রেট, আমরা কি এখন ফান্ডামেন্টাল সমস্যা নিয়ে আলাপ না করে তাহলে এখন টুল আর ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে আলাপ করছি?