আমেরিকায় পড়াশুনা (১) - আত্মসম্মানবোধ

Written on January 1, 2019

আমেরিকায় এসেছি ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে, পিএইচডির খোঁজে। সেই পিএইচডি, যার শুরুকে বলা হয় পড়াশুনার আর গবেষণার যাত্রায় শিক্ষার্থী হিসাবে শেষ ধাপ, আর গবেষক হিসাবে প্রথম ধাপ। মজার ব্যাপার - Ph.D. এর পূর্নরূপ Doctor of Philosophy - এখানে ডক্টর বলতে কি বুঝায়, আর সেখানে দর্শনেরই বা যায়গা কোথায় - তা আমরা অনেকে জানি না। জানি খালি এটা করলে নামপর আগে DR. লাগানো যায়, আর মানুষজন ডক্টর বলে ডাকে। এটার সম্মান এবং আভিজাত্যের কারণে আমাদের দেশে (এবং আমেরিকায় সহ অনেক দেশেই) অনেক প্রতিষ্ঠানে অবশ্য এখন সস্তায় পিএইচডি পাওয়া যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানেও কিছু কনসালটেন্ট দেখেছি যাদের নামের আগে ড: ব্যবহার করেন, এবং তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খোঁজ নিলে দেখা যায় সেগুলো নামকাওয়াস্তে পিএইচডি দিচ্ছে। পার্থক্য হচ্ছে আমেরিকায় বা অন্যান্য উন্নত দেশে পিএইচডি দেখলে খবর নেয় কোন প্রতিষ্ঠানের, পিএইচডি করার সময় কি গবেষণা করেছে, সুপারভাইজর কে ছিলেন, আর আমরা দেখি খালি নামের আগের ডঃ টা।

যাকগে, আমেরিকার পড়াশুনা নিয়ে বলতে গেলে সেটার সম্পূর্ণ চিত্র কখনোই পাওয়া যাবে না আমার লেখা থেকে; উইলিয়াম মেরি যতই প্রেস্টিজিয়াস হোক আর খ্যাতিমান হোক - আমেরিকায় কয়েকশো ইউনিভার্সিটির একটা মাত্রই এটা। তার উপরে আমি আছি কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে - অনেক গুলো ডিপার্টমেন্টের একটা! তো আমার লেখাও হবে ওগুলো নিয়েই। আজকের লেখা শুরু Honor Code বা আত্মসম্মান কোড নিয়ে। উইলিয়াম মেরিতে এসেই আমাদের সবাইকে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিলো, সেটা হলো:

As a member of the William and Mary community, I pledge on my honor not to lie, cheat, or steal, either in my academic or personal life. I understand that such acts violate the Honor Code and undermine the community of trust, of which we are all stewards.

আত্মসম্মান পলিসি

“Honor Code” আমেরিকায় অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এক কথায়, এটা আপনি আপনার নিজের আত্মসম্মানবোধ বজায় রাখতে অনুসরণ করবেন। আপনি পরীক্ষায় কারোটা দেখবেন না, এসাইনমেন্ট করলে অনলাইনে সলুশন খুঁজবেন না, খুঁজলে সেটা লিখে দিবেন যে আপনি দেখেছেন এই ওয়েবসাইট বা মেটেরিয়াল থেকে, ক্লাসমেটদেরটা দেখবেন না - সোজা কথায় আপনি প্রতিটা মার্ক নিজে অর্জন করবেন আত্নসম্মানের সাথে - Honor Code এর কাজ এটা। কিন্তু এখানেই শেষ না! আপনি যদি দেখেন না জানেন আপনার কোন ক্লাসমেেট Honor Code ভাঙ্গছে - তাহলে আপনি সেটা রিপোর্ট করতে বাধ্য। আমাদের দেশের সংষ্কৃতিতে এটা হয়তো মোটেও স্বাভাবিক না, আমরা বরং হয়তো বলবো খাইছে! আমার ক্লাসমেটরে আমি ফেইল করাবো? আপনি হয়তো ভাববেন আহারে, পাশই তো করবে খালি। কিন্তু সেটার প্রভাব কই গিয়ে পড়বে আপনি সেটা চিন্তাও কবরেন না। আপনার প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট পেয়ে যখন কেউ কাজ করতে পারবে না, তখন প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, আপনার সেই ক্লাসমেট ইন্টারভিউতে যখন পারবে না, তখন সে কিভাবে সার্টিফিকেট পেলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, সাথে উঠবে তার সাথের এবং পরের সকল শিক্ষার্থীর সার্টিফিকেট নিয়ে।

আমেরিকানদের চোখে Honor Code ভাঙ্গা একটা অপরাধ। আপনি চুরি করলে সেটার জন্য শাস্তি পাবেন, আপনার ক্লাসমেট আপনার সামনে চুরি করলে আপনি সেটা রিপোর্ট করবেন - চুরি করা যেমন অপরাধ, Honor Code এর বিরুদ্ধে যাওয়া তেমন একাডেমিক অপরাধ। নিজের চোখে দেখা কয়েকটা উদাহরণ দেই, “ক” অনলাইনে সল্যুশন খুঁজে ব্যবহার করেছে, সেটা নিয়ে আমার আমেরিকান বন্ধুরা (আবু - একাধিক জনের বদলে একটাই নাম দিলাম) আলাপ করছিলো:

আবু: ‘ক’ এটা অনলাইনে খুঁজতেছিলো - আমি দেখেছি
আমি: হু, স্যার নাকি ওকে জিজ্ঞাসা করেছে অনলাইনে তুমি এটা খুঁজেছো নাকি
আবু: ‘ক’ যদি বলে সে খুঁজে নাই, আমি তাইলে স্যারকে জানাবো যে সে মিথ্যা বলেছ
আমি: বলো কি! স্যার তোমাকে জিজ্ঞাসা না করলেও?
আবু: হু, কারণ ও হনর কোড ভাঙ্গছে অসততার মাধ্যমে, এটা দুর্নীতি। আমরা সেটা রিপোর্ট না করলে এটা আমাদের দুর্নীতি।

আরেকটা ঘটনা বলি, মিডটার্মে আমি কিছু একটা পারি নাই, সেটা নিয়ে মিডটার্মের স্কোর পাবার পরে আলাপ:

আমি: আচ্ছা মিডটার্মে এটা আমি পারি নাই; একটু তোমার উত্তরটা দেখাবা?
আবু: উহু, দেখানো যাবে না। কারণ এই প্রশ্ন ফাইনালে আসলে তখন আমি তোমাকে সরাসরি উত্তর দেখিয়েছি এরকম হয়ে যাবে।
আমি: এটাও হনর কোড ভাঙ্গবে?
আবু: হু, আমরা নিশ্চিৎ - বুঝতে চাইলে আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিতে পারি; কিন্তু দেখানো যাবে না; স্যারের থেকে অনুমতি নিতে হবে।
আমি: খাইছে! না না তুমি বুঝাও, আমি হনর পলিসি ভাঙ্গতে চাই না।

হনর কোড ভাঙ্গলে শিক্ষকরা সেটা কমিটিতে জানালে স্টুডেন্টের অবস্থা হালুয়া টাইট হয়ে যায় নিশ্চিত। এজন্য অনেক সময় শিক্ষকরা কোড ভাঙ্গার লেভেল অনুসারে আর এর আগে কোড ভাঙ্গার ইতিহাস অনুসারে শাস্তি দেন। আবুদের কাছেই শোনা, ক্যালিফোর্নিয়াতে কিছু প্রেস্টিজিয়াস ইউনিভার্সিটিতে হনর কোড ভাঙ্গলে তার সার্টিফিকেটে পর্যন্ত সেই কথা লেখা থাকে, ফলাফল সেই সার্টিফিকেট আর ৪ বছরের পড়াশুনা পুরোই বৃথা। তাকে কেউ ঐ চাকরিতে নিবেই না। উইলিয়াম মেরিতে শিক্ষকের উপরে নির্ভর করে, কেউ ঐ এসাইনমেন্টে ০ বসিয়ে দেন, পরের বারে আবারো ধরা পড়লে সেটা কমিটিতে যায়, স্টুডেন্টকে তখন পুরো দুই সেমিস্টার বছর প্রবেশন করতে হয় - সোজা কথায় একটা বছর নষ্ট, তার সাথে দুইটা সেমিস্টারের টাকা তো দেয়া আছেই! সেটাও কম না, প্রায় ৩০-৪০ হাজার ডলার। কাজেই হনর কোড বেশ, বেশ গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকায়।