আমেরিকায় পড়াশুনা (২) - কোন ভার্সিটিতে পড়বো?

Written on March 5, 2019

আগেই বলে রাখি, এই লেখাটা যারা শুধুই আমেরিকায় আসতে চান, সেজন্য পড়াশুনার অজুহাতে বা যেকোন অজুহাতে আসবেন তাদের জন্য না। যারা পড়াশুনা নিয়ে আগ্রহী, গবেষণা করতে চান, বা ভালো ক্যারিয়ার গড়তে চান উচ্চ পর্যায়ের পড়াশুনা শেষে, তাদের জন্য। আমি আরো ধরে নিচ্ছি আপনার সিজিপিএ, জিআরই, টোফেল বা আয়েল্টস, পাবলিকেশন এগুলোতে মোটামুটি স্কোর আছে।

আমেরিকায় সাধারণত মানুষ ১০-১২টায় এপ্লাই করে, কেউবা করে ৩০টা ইউনিভার্সিটিতে। গড়পড়তা নিয়ম হচ্ছে এপ্লাই করার আগে তিন ক্যাটেগরিতে ভাগ করা:

  • যেখানে পড়াশুনা করতে পারলে ভাগ্যবান হবে নিজেকে,
  • যেটায় পড়াশুনা করতে পারলে ভালো, আর
  • যেটায় পড়াশুনা করতে পারলে ইউনিভার্সিটি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে।

সাধারণত টপ স্কুলগুলোকে প্রথম ক্যাটেগরির ধরা হয়।

বাংলাদেশ এর উদাহরণ দেই কলেজ দিয়ে। প্রথম ক্যাটাগরির কলেজ হিসেবে হয়তো আপনি নটর ডেমে পড়তে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারবেন। দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে হয়তো কোন কলেজ আপনার পছন্দ কিন্তু শীর্ষ কলেজ হিসেবে ধরা হয় না, এমন কলেজ পাবেন আর তৃতীয় ক্যাটাগরি তে ভুঁইফোড় কলেজ গুলো থাকবে যেগুলো নামকাওয়াস্তে কলেজ - তলে তলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এগুলো অনেকে সময় দেখবেন A+ পাওয়া শিক্ষার্থীদের বলছে এসে ভর্তি হও, বেতন দেয়া লাগবে না, উল্টা টাকা দেব। এগুলো ভালো পরিচিতির আশায় এরকম শিক্ষার্থী খুঁজে যেন HSC পর্যায়ে তুলনামূলক কম পরিশ্রমের বিনিময়ে ভালো রেজাল্ট বাকিদের দেখাতে পারে। আমেরিকায়ও এমন প্রচুর ইউনিভার্সিটি আছে যেগুলো হিসাবে তেমন কাজের না। এগুলো চায় ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে আপনাকে নিয়ে আসতে, বিশেষ করে আপনি যদি নিজে ভালো শিক্ষার্থী হন। নিদেন পক্ষে একটা এপ্লিকেশন পেলেও, সেক্ষেত্রে এপ্লিকেশন ফিটাই ওদের লাভ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং, ছাত্ররা সাধারণত কি কি ফ্যাক্টর হিসাবে নেয়, কি কি নেয়া উচিৎ, প্রফেসররা কি দেখে সাধারণত - এসব নিয়ে মাঝে সাঝেই আলাপ হয় আমাদের সাথে প্রফেসরদের। আবার অনেক সময় প্রফেসররা টপ র‍্যাংকড কনফারেন্সে ওয়ার্কশপ নেন কিভাবে PhD এর প্ল্যান করা উচিত, কি করে আগানো যায় ইত্যাদি নিয়ে। সেগুলো আমি চেয়ে নেই, দেখি আর শিখি। সবকিছু থেকে চুম্বক অংশগুলোর ভিত্তিতে আমার নিজস্ব চিন্তাভাবনা নিয়ে লিখছি।

র‍্যাংকিং

র‍্যাংকিং দেখতে গিয়ে অনেকে ওয়েবসাইটে র‍্যাংকিং দেখে বেশ কিছু র‍্যাংকিং আছে, QS Ranking, Times Higher Education Ranking ইত্যাদি। এগুলোর উপরে নির্ভর করা ঠিক না এজন্য যে এগুলো ডাটা কালেকশনের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই ডাটা পাঠায় না বলে র‍্যাংকিং এ আসেই না। আবার যেসব ডাটা সংগ্রহ করা হয়, সে ডাটায় নানা অংশে নানারকম গুরুত্ব দেয় এক এক প্রতিষ্ঠান। এতে দেখা যায় একই বিশ্ববিদ্যালয় এক এক ওয়েবসাইটে এক একরকম র‍্যাংকিং এ। আবার পাবলিকেশন এর ক্ষেত্রেও ঝামেলা আছে। টপ ক্যাটাগরির কনফারেন্স কোনটা হবে সেটা নিয়ে সাধারণত মতবিরোধ থাকে না। কিন্তু তার পরের ক্যাটাগরির কনফারেন্স কে কেউ গুনেই না, কেউ আবার টপ ক্যাটাগরির সাথেই ধরে, বা কেউ ধরে সেকেন্ড ক্যাটাগরি হিসেবে। যেহেতু এই ধরাধরি বা গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারগুলো সাবজেক্টিভ, তাই র‍্যাংকিং এর উপরে দিনশেষে ভরসা তেমন করা যায় না।

কাজেই সে র‍্যাংকিং গুলো দেখবেন, কিন্তু সেটা দেখবেন ধারণা পেতে, শর্টলিস্ট করতে। তারপরে শুধুমাত্র নিজের জন্য আপনার নিজেরই র‍্যাংকিং করা লাগবে। এই র‍্যাংকিং করার সময় কিছু প্রশ্ন করা লাগবে আপনার:

  • র‍্যাংকিং কি সাবজেক্টের না ইউনিভার্সিটির? নাকি ইউনিভার্সিটির ফ্যাসিলিটির? নাকি ফ্যাকাল্টির?
  • র‍্যাংকিংটায় কি প্রফেসরদের গবেষণার মান উঠে এসেছে?
  • যে সাবজেক্ট র‍্যাংকিং দেখছেন, তার যে ফিল্ডে আপনি কাজ করতে চান সে ফিল্ডে ঐ ডিপার্টমেন্টের কোন প্রফেসরের ভালো পাবলিকেশন আছে?

সাথে সাথে প্রফেসরদেরও তালিকা করা লাগবে, যে তালিকায় র‍্যাংকিং করার সময় নিচের বিষয়গুলোর খেয়াল রাখা লাগবে:

  • প্রফেসর শেষ কবে ফান্ড বা গ্রান্ট পেয়েছেন? উনি কি নিয়মিত গুরুত্ত্বপূর্ণ কনফারেন্স বা জার্নাল কমিটিতে থাকেন?
  • প্রফেসর কি টেনুর পেয়ে গেছেন নাকি পাবেন? বয়স কেমন? রিসার্চ গ্রুপে কতজন ছাত্র বর্তমানে আছে?
  • এডভাইজার হিসাবে প্রফেসর কেমন? সপ্তাহে কি নিয়মিত স্টুডেন্টদের সাথে দেখা হয়? নাকি কাজ দিয়ে মাস দুয়েক উধাও হয়ে যান?
  • ল্যাবে কি স্টুডেন্টরা একজন আরেকজনের সাথে টীম ওয়ার্ক করে নাকি সারাদিন কানাকানি মারামারি করে?
  • ল্যাবের স্টুডেন্টরা গড়ে বছরে কয়টা পেপার বার করে? তারা কি গবেষণার পরে একাডেমিয়াতে গেছে নাকি ইন্ডাস্ট্রিতে?
  • যেখানে যাবেন সেখানের ফান্ডিং এর হিসাবে জীবনযাত্রার খরচ কি উঠে আসবে? নাকি কষ্ট হবে?

এই প্রশ্নগুলো করে আপনার আগাতে হবে। লেখার শুরুতে প্রশ্ন করেছিলাম - কোন ভার্সিটিতে পড়বো? লেখার আলাপ করতে করতে কার সাথে কাজ করবেন সেটায় গিয়ে ঠেঁকেছি। আর এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর আমার মতে। PhD জীবনে একবারই করবেন। তাই সময় নিয়ে প্রস্তুতি নিলেই ভালো। রিসার্চের ক্ষেত্রে সুপারভাইজার আপনাকে গড়তে পারে বা ভাঙতে পারে। PhD কে অনেকে শুধুমাত্র একটা ডিগ্রি হিসাবে দেখে, কিন্তু পরিসংখ্যান বলে PhD করতে শিক্ষার্থীদের এক তৃতীয়াংশ বা তার বেশি মানসিক চাপে ভুগে এবং পরবর্তীতে মানসিক সমস্যায় বা ডিপ্রেশনে পড়তে পারে। তাই ভালো সুপারভাইজারের বিকল্প নেই, একদমই নেই। সব মিলিয়ে খুব ভালোমতো আঁটঘাঁট বেঁধে নামা উচিত ইউনিভার্সিটি সিলেক্ট করার সময়।

সবার জন্য শুভকামনা :)