শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রস্তাবসমুহ এবং আমার মতামত

Written on May 5, 2019

শিক্ষক নেটওয়ার্কের উদ্যোগে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবর্তন নিয়ে বেশ কিছু প্রস্তাব এসেছে, অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। সেটাকে আরো ভালো করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যেগুলো নিয়ে মতামত আছে, শুধুমাত্র সেগুলো এখানে উল্লেখ করা হলো।

১. রাষ্ট্রের হাতে যে সমাধান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কটগুলো রাষ্ট্রব্যবস্থার সংকটের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্কটগুলোর সমাধান হওয়া দরকার। সরকারগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বাস করে না, নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। আজকের জন্য এমন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় চাই যা চিন্তার স্বাধীনতা, প্রশ্ন করার পরিসর এবং বিশ্লেষণের বিস্তার নিয়ে তৈরী হবে। সরকারকে এক্ষেত্রে উদার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের মতো চলতে দিতে হবে। উন্নয়নের ধারায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, শিক্ষাখাতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করতে হবে।

স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। সরকারগুলোর নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার মাধ্যম কি? শিক্ষক রাজনীতি? বা অন্য কিছু? সরকার যদি নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা বা ব্যবহার করে - তারা নিজ স্বার্থ কেন ছাড়বে? উত্তরগুলো আমরা জানি, সুতরাং এখানে স্পষ্ট হওয়ার বিকল্প নেই, আর ছাড় দেবারও সুযোগ নেই।

২. ইউজিসির কৌশলপত্র ও নয়া উদারবাদী নীতি নব্য উদারবাদী মতাদর্শের আলোকে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বব্যাংক প্রণীত বাণিজ্যিকীকরণের নীতি থেকে সরে আসতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী উচ্চশিক্ষাকে দরিদ্র মানুষদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। নৈশ বা সান্ধ্য কোর্সগুলোকে ধীরে ধীরে তুলে নিতে হবে। বছর বছর ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন বাড়ানো বন্ধ করতে হবে।

এগুলো নির্ভর করছে শিক্ষাখাতে সরকারের দেয়া বাজেটের উপরে। সেই নির্ভরশীলতা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? উচ্চ শিক্ষার সংজ্ঞা কি? ব্যাচেলরস থেকেই? নাকি মাস্টার্স, বা পিএইচডি? এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশে কি হয় সে মডেলগুলোও দেখা লাগবে।

উদাহরণ হিসাবে বলি - আমি আমেরিকায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি, William & Mary (W&M), সেটি পাবলিক আইভি ক্যাটেগরির, পাবলিক ইউনিভার্সিটি। সেখানে ব্যাচেলরস এ স্কলারশীপ না দিলে ভালো পরিমাণের টাকা দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। আর পিএইচডির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের টিউশনফি দিতে হয় না মোটামুটি সব ক্ষেত্রেই, সাথে আবার টাকাও পায় Teaching Assistant / Graduate Assistant হিসাবে কাজ করে। যতদূর জানি, আমাদের পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে এমন সুযোগ শিক্ষার্থীদের দেয়ার কোন নীতি নেই।

৫. পাঠদান ও গবেষণা পাঠদানের মতো ন্যূনতম কাজটিতে শিক্ষকদের জবাবদিহিতার পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে। পাঠদান শিক্ষকের প্রথম কাজ, দ্বিতীয় কাজ গবেষণা। ভালো ভালো শিক্ষক ভালো গবেষক নাও হতে পারেন, উল্টোটাও ঘটতে পারে। শিক্ষকের আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী লোড বন্টনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে এবং তাদের স্বীকতি ও প্রমশনের সেই আলোকে গবেষণার জন্য সরকারকে প্রচুর বরাদ্দ দিতে হবে। গবেষণার অনুদান প্রাপ্তিতে দলগত পরিচয়ের প্রাধান্য বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ ও আদান প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ধরার সফটওয়্যার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে হবে। দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সার্বক্ষণিক পিএইচডি-এমফিল ডিগি চালু করা।

এক্ষেত্রে আমার মতামত অনেকগুলো, একটা একটা করে আসি।

পাঠদানের মতো ন্যূনতম কাজটিতে শিক্ষকদের জবাবদিহিতার পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে।

কর্মঘন্টার আওতায় কি কি আসে? পাঠদান? পরীক্ষার খাতা দেখা? নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানারকম কমিটির হয়ে না গবেষনা, না শিক্ষকতা জাতীয় কাজ করা লাগে, সেগুলোও? যদি শুধুমাত্র শিক্ষকতা আসে, বাকিগুলোর ক্ষেত্রে সময় দিতে হলে শিক্ষক হিসাবে তাকে কিভাবে যুক্ত করা যাবে? বা আদৌ সেগুলোতে তাকে যুক্ত করা যাবে নাকি?

গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি করলে শিক্ষকদের জবাবদিহিতা কিরকম জানি না, কিন্তু গত কয়েক বছরে অনেকবার খবর এসেছে যে শিক্ষকরা চৌর্যবৃত্তি করেছেন - তাদের বিষয়ে কমিটি তৈরি হওয়া পর্যন্ত যা হবার হয়েছে। তার পরে কি হয়েছে আমি কোন খবরে দেখিনি, ধরে নিচ্ছি সেগুলো সবাই ভুলে গেছে আর তারাও বহাল তবিয়তে শিক্ষক হয়ে আছেন এখনো।

পাঠদান শিক্ষকের প্রথম কাজ, দ্বিতীয় কাজ গবেষণা। ভালো ভালো শিক্ষক ভালো গবেষক নাও হতে পারেন, উল্টোটাও ঘটতে পারে। শিক্ষকের আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী লোড বন্টনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে এবং তাদের স্বীকতি ও প্রমশনের সেই আলোকে গবেষণার জন্য সরকারকে প্রচুর বরাদ্দ দিতে হবে। গবেষণার অনুদান প্রাপ্তিতে দলগত পরিচয়ের প্রাধান্য বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ ও আদান প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

এক্ষেত্রে আমার বেশ কিছু মতামত আছে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কাজ অনুসারে তার পজিশন হওয়া উচিত। আবারো W&M এর কথাই ধরি, আপনি পিএইচডি করে আসলেও যদি খালি শিক্ষকতা করতে চান গবেষণা না করে, আপনার পদবী এর নাম হবে লেকচারার, বেতন হয়তো অধ্যাপকের সমমানের হতে পারে সময়ের সাথে। কিন্তু অধ্যাপক শব্দটা যারা গবেষণা করছেন, তাদের জন্য। তাদের বছর শেষে রিপোর্ট দেয়া লাগে কি গবেষণা করেছেন সারা বছর ধরে। এক কথায়, অধ্যাপক পদবীটা অর্জন করা লাগবে।

দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা মূল না গবেষণা - সেটা বিতর্কের বিষয় এবং অনেক কিছুর উপরে নির্ভর করে। বিশ্ববিদ্যালয় কি বিষয়ে ফোকাস করছে, তার মূল লক্ষ্য কি এসবের উপরে ভিত্তি করে ঠিক করা উচিত মূল লক্ষ্য কি গবেষণা নাকি শিক্ষা।

গবেষণার গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। কারণ গবেষণার মাধ্যমে দেশের সমস্যার লাগসই সমাধান উঠে আসে, নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়, ভিনদেশি প্রযুক্তির উপরে নির্ভরশীলতা কমে। শিক্ষকতায় আপনি ক্লাসে পাঠদানের মাধ্যমে দেশের কিছু অংশের মাঝে পরিবর্তন আনতে পারবেন, কিন্তু গবেষণা করে দেশে যে পরিবর্তন আনা যায়, তার প্রভাবও নেহাৎ কম নয়। কোরিয়ার প্রফেসরদের সাথে এই বিষয়ে আলাপ হয়েছিল গতবছর, সেখানে শুনেছিলাম তারা ইন্ড্রাস্ট্রি একাডেমিয়া কোলাবোরেশন করে গবেষণা থেকে ইন্ডাস্ট্রিতে কিভাবে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা যায় সে বিষয়ে কজ করছেন।

তৃতীয়ত, গবেষণায় অনুদান পেলে সেটার যথাযথ ব্যবহার তো লাগবেই, সেই অনুদানটার পাশাপাশি কনফারেন্সে যোগদান করতে, বা জার্নালের জন্যেও প্রয়োজন অনুসারে আলাদা বরাদ্দ লাগবে। আমার গতবছর প্রথম সারির কনফারেন্সে যোগদান করতে সুইডেন যাওয়ার সময় ঘাম ছুটে গিয়েছিল কনফারেন্সের রেজিস্ট্রেশনের টাকা, প্লেনের টিকেটের টাকা যোগাড় করতে। ইউজিসি আর ঢাবি আমাকে সহায়তা দিয়েছিলো, সাথে গবেষণায় অনুদানের টাকা - সব মিলিয়ে পেরেছিলাম। কিন্তু বেশিরভাগ টাকা পেয়েছিলাম কনফারেন্স থেকে ফেরত এসে, সকল প্রমাণপত্র জমা দেবার পরে। আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে এখন কনফারেন্সে রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে আগে আর্থিক যে ছাড়গুলো পেতাম, সেগুলো আর পাবো না। কিন্তু অনুদানের পরিমাণ বাড়েনি।

আরো কিছু ঝামেলা আছে - যদি শিক্ষার্থীরা গবেষণা করে - তাদের পাবলিকেশন পৃথিবীর এক নাম্বার কনফারেন্সে পাবলিশ করলেও টাকা যোগাড় করা অনেক কঠিন, তবে সেটা আরেক আলাপ, তবে সংক্ষেপে বলি - হাঙেরি থেকে আসা শিক্ষার্থীর সাথে আলাপে জেনেছিলাম তার পাবলিকেশন নাই, কিন্তু এসে যেন দেখে শিখতে পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় থাকা, খাওয়া, রেজিস্ট্রেশন - সবকিছুর টাকা দিয়েছে। গবেষণায় উৎসাহিত করার জন্য আর কি লাগে তাহলে?

সর্বশেষ, সার্বক্ষনিক পিএইচডি বা এমফিল করা শিক্ষার্থীদের কিন্তু উপযুক্ত পরিমাণে স্কলারশীপ না দিলে ভালো শিক্ষার্থীরা বাইরে চলে যাবে। আর সেই শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষনিক শিক্ষার্থী হয়েই ডিগ্রি অর্জন করা লাগবে, চাকরির ফাঁকে না।

৬. ভর্তি নিয়োগে ও প্রশাসন ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতি ধাপে ধাপে পরিবর্তন করতে হবে। প্রশ্নের ধরণ পাল্টাতে হবে আগে, সম্পূর্ণ এমসিকিউভিত্তিক ভর্তিপরীক্ষা থেকে সরে এসে, এপ্টিচ্যুড টেষ্টে যেতে হবে। প্রথম বর্ষ থেকে সবাইকে হলে সিট দিয়ে দিতে হবে। প্রভাষক পদে নিয়োগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে এ বিষয়ে নিয়োগপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। দলগত ও আঞ্চলিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়াগে সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বিভাগে পাস করা শিক্ষার্থীদের ওই বিভাগে চাকরি দেবার প্রবণতা বদলাতে হবে।

ভালো প্রস্তাব। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ নিয়োগেও নজর দেয়া জরুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকশ, দক্ষ স্টাফ না থাকলে স্টাফদের কাজ শিক্ষকদের শুধরে দিতেই সময় নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো একবার পার্মানেন্ট হলে চাকরি যায় না, স্টাফরা তখন কাজে কতটুকু মনযোগী থাকে সেটা আলোচনার বিষয়। ল্যাব, অফিসিয়াল কাজকর্ম, বা যেসব কাজে শিক্ষকদের থাকা জরুরী নয়, তার সবকিছু স্টাফদের মাধ্যমে করিয়ে বাকি সময় শিক্ষকতা বা গবেষণায় দেয়া জরুরী।

সবমিলিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাখাত নিয়ে গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ভাবছি, কিন্তু এটা নিয়ে একটা সম্মিলিত উদ্যোগের দরকার ছিলো। এতদিনে সেটা দেখতে পেরে আমি খুশি এবং কৃতজ্ঞ। আশা করি এগুলোর মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে আমাদের শিক্ষাখাতের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো।

অমিত শীল অমি,

সহকারী অধ্যাপক,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (পিএইচডির জন্য আমেরিকায় William & Mary তে আছেন শিক্ষাছুটিতে)