টাইমস এর র‍্যাংকিংয়ে নেই একটিও বিশ্ববিদ্যালয় - আসলেই?

Written on May 11, 2019 , Last updated on: June 25, 2023

টাইমস হায়ার এডুকেশন র‍্যাংকিং নিয়ে বেশ কিছু আলাপ আলোচনা দেখছি গত কয়দিন ধরেই। অনেকে হাহাকার করছেন, অনেকে হাসাহাসি করছেন কেন এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা আর কারো নাম নাই, অনেকে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে ফেলছেন।

একই ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের র‍্যাংকিং এ পুরো বাংলাদেশ থেকে কেবল মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো এশিয়ান র‍্যাংকিং এ, তাও প্রথম ৩০১-৩৫০ ক্যাটাগরিতে, এক বছরে এত খারাপ করলো যে ২০১৯ সাল এর র‍্যাংকিং এ বেমালুম বিলুপ্ত হয়ে গেল? একদম নাই?

আমি ভাবলাম ব্যাপারটা একটু ঘেঁটে দেখি।

এই নিন মেথডলজি, কেমন করে ডাটা কালেক্ট করে তার বিস্তারিত।

র‍্যাংক এ থাকতে হলে ৭টা শর্ত অবশ্যই পূরন করতে হবে, তার একটা হলো:

If an institution has not supplied any “overall” numbers for the ranking year they are excluded from the ranking.

মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ডাটা পাঠানো তাদের ডাটা কালেকশনের অন্যতম প্রক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে না পাঠালে এরাও র‍্যাংকিংয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয় কে রাখবে না। আর যদি সব শর্ত পূরণ করে, তাহলে র‍্যাংকিং পাবে।

ঘটনা যে আসলেই তাই, তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজি স্যারের পোস্টে দেখলাম। উনি টাইমস হায়ার এডুকেশনকে ইমেইল করেছিলেন, র‍্যাংকিং এ বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই কেন তা জানতে চেয়ে। তাদের সোজা সাপটা উত্তর, ডাটা নাই!

এবারে প্রশ্ন দুইটা করি, একটার উত্তর আমি দেব, আরেকটা আপনাদের ভাবার জন্য থাকলো:

১)

এরা র‍্যাংক করার আগে বলে ডাটা পাঠান, পাঠানোর পরে এরাও নানা হিসাব নিকাশ করে একটা র‍্যাংক দেয়। ডাটা না থাকলে সেটা ওরা প্রক্রিয়াতেই নেয় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে কি এখানে কোন ডাটা পাঠানো হয়? পাঠানোর দায়িত্বে আদৌও কি কেউ আছে?

যদি না থাকে, বিশ্বের এক নাম্বার ভার্সিটি হলেও লাভ নাই যদি কেউ ডাটা না পাঠায় ভার্সিটির পক্ষ থেকে।

২)

প্রশ্ন করার আগে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দেই। এসব র‍্যাংকিং এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর গবেষণা। গবেষণা করতে টাকা লাগে। পাবলিশ করতেও টাকা লাগে। এখানে যাদের র‍্যাংকিং আছে, তাদের সাথে তুলনা করতে চাই আমরা। খুবই ভালো মানসিকতা।

তাহলে বাইরের দেশে কি কি সুবিধা পায় মানুষ সেটা দিয়েও তুলনা করা লাগে, নাকি? বাইরে স্টুডেন্টদের দিয়ে গবেষনা করালে টাকা দেয় ভার্সিটি, কারণ এসব গবেষণার কারণে দেশের উন্নয়ন হয়। ভার্সিটি হয় শিক্ষা বাবদ বিশাল রকমের খরচ নেয় আন্ডারগ্রাড শিক্ষার্থীদের থেকে, নাহলে সরকারের থেকে টাকা নেয়। আমরা না শিক্ষার্থীদের থেকে টাকা নেই সেরকম, না সরকারের থেকে তেমন টাকা পাই। কিরকম পাই তার একটা উদাহরণ দেই। কনফারেন্সে গেছি ইউজিসি, ঢাবি - দুই প্রতিষ্ঠান থেকে গ্র্যান্ট নিয়ে। মানুষের লাগে একটা গ্র্যান্ট, আমি পেলাম দুইটা!

গ্র্যান্টগুলো দিয়ে কি হয়? আপনি কনফারেন্সে পাবলিকেশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করবেন তার জন্য ওখানে থাকা লাগবে, যাতায়াত খরচ লাগবে, খাওয়া লাগবে, রেজিস্ট্রেশন করা লাগবে - এসব খরচের জন্য গ্র্যান্ট। এমনও দেখেছি বাইরের দেশের শিক্ষার্থীরা ওখানে অংশ নিতে গেছে পাবলিকেশন ছাড়াই। যেন একটু দেখে শিখতে পারে তাদের জন্য ভার্সিটি গ্র্যান্ট দিয়েছে। খেয়েছে থেকেছে হোটেলে। আর আমি প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের প্রভাষক হয়ে থেকেছি হোস্টেলে ১৬জনের সাথে রুম শেয়ার করে। জ্বি, ১৬। এগুলোর জন্য বিন্দুমাত্র এতে লজ্জ্বা বা অভিমান হয়নি, কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কট বা দুর্বলতা বুঝি। টাকা নাই এটা বুঝার জন্য হলগুলোর শিক্ষার্থীদের অবস্থা দেখলেই চলে আসলে, আর কিছু দেখা লাগে না।

তার মানে কি এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষককে গবেষণাবাবদ টাকা দেয়া শুরু করতে হবে? অবশ্যই না। কোথাও সবাইকে গবেষণার টাকা দেয় না। সেটা বেছে বেছেই দেয়। কিন্তু গবেষণার পাবলিকেশন হলে প্রতিষ্ঠান থেকে সবরকম ভাবে সাহায্য করা হয়, কারণ পাবলিকেশনের মাধ্যমে সুনাম প্রতিষ্ঠানেরও হয়। শিক্ষকদের উৎসাহ দিতে অনেক সময় বোনাস বেতন দেয়া হয়, শিক্ষার্থীদের কথা গর্ব করে সবাইকে জানান দেয়া হয়।

আমাদের নিয়ে আলাপ করার আগে একটু ভাবুন, গবেষণা র‍্যাংকিং বান্ধব কোন কাজটা হয় আমাদের দেশে। শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে আমার কোটি খানেক অভিযোগ আছে, নিয়োগ নীতি, প্রমোশন, পাবলিকেশন ইত্যাদি নিয়ে আছে লাখখানেক - কিন্তু সব্বাই তো আর রাজনীতি করে না। সবাই তো খারাপ না। গবেষণা করতে চায়, দেশকে নিয়ে কাজ করতে চায় এমন শিক্ষকও তো অনেক আছেন। বাইরের টপ র‍্যাংকড গবেষণার গ্রুপ থেকে পিএইচডি করে এসেছেন এমন শিক্ষকদের আমি চিনি, যারা দেশে গবেষণা করতে পারছেন না এসব সমস্যার কারণে। শিক্ষকদের কথা ছাড়ুন, শিক্ষার্থীরা তো গবেষণা পর্যায়ে গ্রান্টই পায় না কোনরকম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, বরং নিজের টাকা দিয়েই পড়াশুনা করে। কোথাও গবেষণা সাবমিট করার আগে দুইবার ভাবে, ওখানে গবেষণার কাজ এসেপ্ট হলে রেজিস্ট্রেশনের টাকা আছে নাকি, যেতে পারবে নাকি - আরো কত কিছু।

তো প্রশ্ন হলো: এত সমস্যা নিয়ে ভালো র‍্যাংকিং কি বাতাস থেকে আসবে?

ভালো কথা, এসব র‍্যাংকিং এ থাকলেও খুশি হবার তেমন কিছু নাই। এসব র‍্যাংকিং সাপের তেলের মতো, শুনতে খুব ভালো - বাস্তবতায় অত ভালো না। এক এক র‍্যাংকিং এক এক বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্ব দেয় মার্কেটিং এর সুবিধা দেখে, সবগুলোইতেই ভেজাল আছে কম বেশি। সময় করে হয়তো আরেকদিন এই ব্যাপারে নিয়ে “মতামত” দিবো।

বোনাস প্রশ্ন

বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে দেখলাম খবর এর শিরোনাম: “এশিয়ার ৪০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই কেন?

এই কেন এর উত্তর বিবিসি বাংলা খুঁজেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতামত থেকে। কিন্তু উত্তর তো আগে খোঁজার দরকার ছিল টাইমস এর থেকে। আগে জানতাম খবর হলো তথ্য, এখন জানছি খবর মানে মতামত। তো মতামত দিলেই যদি খবর হয়, তাহলে বিবিসি বাংলার সাথে “খুন জখম ছিনতাই” জাতীয় সাপ্তাহিক গুলোর পার্থক্য কি আদৌ থাকছে?

অমিত শীল অমি, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। (পিএইচডির জন্য আমেরিকায় William & Mary তে আছেন শিক্ষাছুটিতে)