আত্মহত্যা: কিভাবে ঠেকানো যায়, আর আমাদের ভূমিকা

Written on July 7, 2019

আত্মহত্যা থামানোর জন্য কি করা যায়, শিক্ষক, ছাত্র (পড়ুন বন্ধু) এবং কর্মচারী হিসেবে - এই বিষয়ে ১লা জুলাই একটা ওয়ার্কশপ হলো William & Mary তে। আমেরিকায় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ আত্মহত্যা। প্রতি বছর প্রায় ৪৫,০০০ শিক্ষার্থী মারা যায় আত্মহত্যা করে! বাংলাদেশেও প্রায় ৬৫লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছেপ্রতিদিন প্রায় ২৯জন মারা যাচ্ছে বাংলাদশে আত্মহত্যা করে। উইলিয়াম মেরি তো আরেক কাঠি বাড়া - পরিচিতই ছিলো Suicide School হিসেবে!

বর্তমানে অবশ্য ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হয়েছে - উইলিয়াম মেরি এখন আমেরিকায় আন্ডারগ্রেড লেভেলে অনেক কেয়ারিং স্কুল হিসাবে র‍্যাংকিং এ আসে নিয়মিতই। তার উপরে উইলিয়াম মেরির শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে সুখী শিক্ষার্থী আমেরিকায় - এমন র‍্যাংকিং তো আছেই ! অনেকগুলো পদক্ষেপের মাঝে ওরা যেটা করে সেটা হলো নিয়মিত আত্মহত্যা ঠেকানো (সুইসাইড প্রিভেনশন) বিষয়ে ওয়ার্কশপ করে। ওয়ার্কশপ নেন সাইকোলোজিস্টরা, আর শিক্ষকতা লাইনে যারা আছেন তারা মিলে। আমার এটায় এটেন্ড করার জন্য আরো বেশি আগ্রহ ছিলো কারণ আমি ব্যক্তিগত ভাবে অন্ততঃ তিনজনকে চিনি যারা কোন না কোন সময় আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। আরো বেশি চেয়েছি কারণ বাংলাদেশে প্রায়ই শুনি মানুষ আত্মহত্যা করেছে - কোন না কোন কারণে। আত্মহত্যা হবার পরে অনেক আহা উহু ইত্যাদি জানতে পারলেও আত্মহত্যার অশনিসংকেত কি, কি দেখে বুঝা যেতে পারে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে, এবং কিভাবে তাকে সাহায্য করা যায় - এ বিষয়ে জানার আগ্রহ থেকেই যাওয়া।

আগেই পরিষ্কার করে বলি, এটা সাধারণ মানুষ হিসাবে সাহায্য করা - একদমই প্রাথমিক পর্যায়ের সাহায্য। মূল সাহায্য অবশ্যই করবে কাউন্সেলিং বা হেল্থ সেন্টার - কিন্তু সেই সাহায্যের সাথে আশেপাশের মানুষ হিসাবে আমরা কি করতে পারি, কিভাবে ঝামেলা বড় হবার আগেই ঠেকাতে পারি - সে বিষয়েই ওয়ার্কশপ। সেখানে যা জেনেছি, যা বুঝেছি তার ভিত্তিতে এই লেখা। ওয়ার্কশপে কি হয়েছে তা আলাপের আগে আসুন একটা ছোট্ট, এক মিনিটের মেন্টাল এক্সারসাইজ করি।

পরীক্ষাটা করতে চাইলে আগেই কাগজ কলম, স্টপওয়াচ জোগাড় করে রাখুন। পুরো ইন্সট্রাকশন পড়ে শেষ করার সাথে সাথেই শুরু করা লাগবে । পরে করলে হবে না।

"রেডি? এখানে ক্লিক করুন" - কাগজ কলম নিয়ে বসুুন, - আপনি যা মনে আসে লিখবেন খাতায় পরের এক মিনিট। "যা মনে আসে" মানে যা মনে আসে, কোন লুকোছাপা নেই। কাউকে দেখানো লাগবে না। কাগজ চাইলে পুড়িয়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু লেখা লাগবেই - যা মনে আছে। - একটা শব্দ নিয়ে ভাবতে বা লিখতে পারবেন না এই এক মিনিট। ভাবলেই েখায় একটা চিহ্ন দিবেন - ক্রস (x) বা এ জাতীয় কিছু - যেটা দিয়ে সহজে গোনা যাবে কতবার ভেবেছেন শব্দটা। শব্দটা হলো ছাগল। - শুরু!

পরীক্ষাটার একটা নাম আছে, White Bear Experiment। আমরা সাদা ভালুকের সাথে পরিচিত নাও হতে পারি, তাই আমি ছাগল দিয়ে করালাম। পরীক্ষাটা আপনি ঠিক মতো করলে পৃথিবীার বাকি সবার সাথে আপনার রেজাল্ট একই হবে - আপনি তেমন কিছু লিখতে পারেননি, কারণ আপনি ছাগল ছাড়া আর তেমন কিছু ভাবতে পারছেন না। হয়তো আপনার লেখার অবস্থা এমন হয়ে গেছে: আচ্ছা লেখা শুরু করছি, কি যেন ভাবা যাবে না? ছাগল। x যাহ বাব্বা, আর ভাবছিনা এই ছাগল শব্দটা x .. x ..xxxxxx। চাইলে নিচে কমেন্ট করতে পারেন কতবার x খেয়েছেন। আমি খেয়েছিলাম ১০ বারের উপরে।

ওদের ভাষায়,

Thought Suppression may end up with obsessive thoughts

আচ্ছা এবারে সময় থাকলে ৫ মিনিট আরেকটা পরীক্ষা করি আসেন। খাতা কলম নিয়ে আবারো! এক মনে, এক ধ্যানে ছাগল বিষয়ে মনে যা আছে তা লিখতে হবে। আর কিচ্ছু না। শুরু!

৫ মিনিট ছাগল নিয়ে লেখা কি লিখতে পেরেছেন? ঝরঝর করে তড়তড়িয়ে লিখতে পারার কথা এই ৫ মিনিট। হয়তো ৫ মিনিটের আগেই যা মনে আছে তা লিখে ফেলে বসে আছেন, আর কিছু মাথায় আসছে না, তাই চুপচাপ বসে আছেন। :) এই দুটো পরীক্ষার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে আত্মহত্যা ঠেকানোর ক্ষেত্রে, পড়তে থাকুন - ব্যখা পেয়ে যাবেন। ওয়ার্কশপ প্রথমেই শুরু হলো একটা ভিডিও দেখে:

দেখে তো ব্যাপক হাসি সবার - ভদ্রমহিলার মাথা থেকে পেরেক সরাতে চাই আমরা কারা - এ প্রশ্নে মোটামুটি সবাই উত্তর দিলাম চাই। আস্তে আস্তে তিন ঘব্টার ওয়ার্কশপে অবশ্য বুঝে গেলাম - কেন পেরেক বের করলেও লাভ নাই, কারণ মহিলার মাথার পেরেকটা আটকে গেছে এটা আসল সমস্যা না, সমস্যা মাথাটাই পেরেক তৈরি করছে।

প্রথমেই আমাদের জানাল‌ো, উইলিয়াম মেরির গত কয়েকবছরের সার্ভে অনুসারে ৯-১০% শিক্ষার্থী সিরিয়াসভাবে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করলেও মাত্র ৫০% স্বীকার করে যে তাদের সাহায্য দরকার। তাদের মাত্র ২৫%আসলেই সাহায্য পেতে উদ্যোগ গ্রহন করে। সাহায্যের জন্য বা উপদেশের জন্য তারা প্রথমেই যায় ফ্যাকাল্টির কাছে (৩৫%), তারপরে যায় ডিনের কাছে (২৫%) আর যায় একাডেমিক এডভাইজারের কাছে (২৫%)।

তারপরে আমাদের ১৬জনের ছবি দেখিয়ে বললো, কার কার চেহারা দেখে মনে হয় আত্মহত্যা করতে পারে? ১৬জনই শিক্ষার্থী, সাথে বয়স দেয়া। সর্বোচ্চ বয়স ১৮, সর্ববিম্ন - ১১ বছর। সবাই আন্দাজ করলাম দুই বা তিনজনের ব্যাপারে সর্বোচ্চ - যার মুখে হাসি নাই, গোমড়া - এধরণের বাচ্চাকাচ্চাগুলো হয়তো আত্মহত্যা করেছে।

পরে জানলাম ১৬জনই আত্মহত্যা করেছে। চেহারা দেখে বুঝা সম্ভব না কেউ আত্মহত্যা করতে চায় বা চায় না এ বিষয়ে।

তা কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? অনেক কারণেই করতে পারে, যেমন:

  • ব্রেকআপ
  • পরিবারের কেউ মারা গেছে এই শোকে
  • যৌন বা পারিবারিক অত্যাচার
  • একাডেমিক ব্যর্থতা
  • নিজেকে ঘৃণা করা
  • হতাশা
  • আর্থিক সমস্যা
  • বন্ধুর সাথে সমস্যা
  • এলকোহল

আত্মহ্ত্যা যারা করতে চায়, তারা কি কি মানসিক আবেগে সবচেয়ে বেশি ভুগে? সাধারণত:

  • রাগ
  • অন্যরা বেশি সমালোচনা করছে (জাজমেন্টাল)
  • হতাশা
  • ভয়
  • দুশ্চিন্তা
  • অপরাধবোধ
  • একাকীত্ব
  • নিজেকে সমাজের বোঝা ভাবা ইত্যাদি।

মোদ্দা কথা, আত্মহত্যাকারী মাত্রেই যে ডিপ্রেশনে থাকবে, বা ডিপ্রেসড মানুষ মাত্রেই যে আত্মহত্যা করবে এটা ভুল।

তবে সাইকোলোজিস্টদের মতে, আত্মহত্যাকারী শারীরিক বা মানসিক বা উভয় কষ্ট সবচেয়ে বেশি অনুভব করে। এতটাই বেশি কষ্ট পায় যে তারা সে কষ্ট সামলাতে না পেরে আত্মহত্যা করে বসে।

“Suicide happens when it crosses the threshold of coping pain”

ভবিষ্যৎ আত্মহত্যাকারীর নানারকম লক্ষণ দেখা যেতে পারে:

  • কিছুতেই কিছু আসে যায় না
  • হতাশা
  • আত্মহত্যার হুমকি দেয়া
  • আত্মহত্যার চেষ্টা করা
  • ক্লাসে হঠাৎ করেই অনুপস্থিত হওয়া শুরু করা
  • নিজের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা (হাত কাটা যেমন)
  • কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে I’m okay বলে এড়িয়ে যাওয়া, যেখানে স্পষ্টতই - তাকে দেখে বুঝা যায় সে ভালো নেই
  • সামাজিক মাধ্যমে হতাশাজনক পোস্ট দেয়া, ইত্যাদি

কেউ যখন আত্মহত্যা করতে চায় বলে মনে হয় - তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করা উচিৎ সে আত্মহত্যা করার কথা ভাবছে নাকি। অনেকে ভাবে এটা অনেকটা পাগলকে মনে করিয়ে দেয়ার মত‌ো - “ওরে, গালি দিচ্ছিস দে, পাথর মারিস নে আবার”। কিন্ত ব্যাপারটা এমন না। বরং জিজ্ঞাসা করলে প্রশ্নকারী যে তার সমস্যাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তার কথা ভাবছে - এই অনুভূতি পায়। আত্মহত্যা করার ঝুঁকিতে আছে এমন মানুষের সাথে কথা বলার সময় যা যা করা যেতে পারে:

  • জানতে চাওয়া, কি হয়েছে (asking)
  • মন দিয়ে শোনা (active listening)
  • নিশ্চিত করা যে সে আসলেই আত্মহত্যা বা নিজের ক্ষতি করার চিন্তা করছে - (validating/affirming)
  • Paraphrasing (reflection)

আর যে জিনিষগুলো করা উচিৎ না:

  • Advice - উপদেশ দেয়া (tell what to do)
  • Interpretation - ব্যখা করা (যার সমস্যা তারে আবার বুঝানো, সমস্যাটা - কেন হচ্ছে)
  • Assurance - সব ঠিক আছে এমন সান্তনা দেয়া (everything is fine, - everything is going to be okay)
  • একমাত্র ভরসার আশ্রয়স্থল হওয়া, আপনার চেষ্টা করতে হবে যেন সে আরো মানুষের থেকে সাহায্য পায়, খালি আপনার একার সাথেই সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করতে গিয়ে আপনার উপরে অতিরিক্ত নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে

উদাহরণ হিসাবে এই ভিডিওটা দেখলাম:

উপরে আমরা যে মেন্টাল এক্সারসাইজ করে আসলাম - তার মূল কথা এই। আপনি তাকে কথা বলার সুযোগ করে দিলে সে বলে কয়ে হালকা হবে। আপনিও তাকে আরো সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু আপনি তাকে যদি সমাধান চাপিয়ে দিলে, উপদেশ দিলে, বা “এসব তো ব্যাপার না। আমি এর চেয়ে আরো কত খারাপ অবস্থার ভিতর দিয়ে গেছি। এখন ভালো আছি না?” বললে তেমন কাজ হবে না। কারণ সে চেষ্টা করবে তার খারাপ অনুভূতিগুলোকে চেপে রাখতে, রাখতে গিয়ে সেগুলোই মাথায় ঘুরপাক খাবে। একসময় সে এই চেপে রাখা অনুভূতি সামলে রাখতে পারবে না, বরং অনুভূতির ঘুর্ণিপাক সামলাতে না পেরে কোন একসময় নিজের ক্ষতি করে বসবে। কথায় আছে, “যার দুঃখ, সেই বুঝে“।

দিনশেষে আপনার মিশন হবে তাকে যেভাবে হোক কাউন্সেলিং করানো‌। এ ছাড়া আপনি কিচ্ছু করতে পারবেন না। মানসিক সমস্যা মানেই পাগল না, বা ডিপ্রেসড না। সেটা কি, তা নির্ধারণ করার কাজটা সাইকোলজিস্ট আর ডাক্তারদের হাতেই ছেড়ে দিন। আপনি নিশ্চিত করুন, যেন কষ্টে থাকা মানুষটা চিকিৎসা পায়, সাহায্য পায়। অসময়ে আত্মহত্যা না করে।

শুভ কামনা রইলো সবার জন্য।

যথাযত ডিসক্লেইমার: আমার পড়াশুনার লাইন সাইকোলজির ১০ মাইলের ভিতরে নেই। যা লিখেছি, তা ওয়ার্কশপে আমার নেয়া নোটের ভিত্তিতে। তাও ভুল থাকতে পারে, থাকতে পারে অসংগতি। আমি আমার বন্ধুতালিকার উপযুক্ত ব্যক্তিদের থেকে মতামত নিয়ে নিবো এই বিষয়ে, আর তার পরে দরকার মতো সংশোধন, পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করে নিবো। লেখার ছবি নিয়েছি সমকাল.কম থেকে।