আমার চোখে ২০২১ এ বাংলাদেশের এয়ারপোর্ট, থানা, নির্বাচনী আর পাসপোর্ট অফিস

Written on December 13, 2021

জুলাই ২০১৮ থেকে নভেম্বর ২০২১ - এই সাড়ে ৩ বছর বাংলাদেশে ছিলাম না। আসার পরেই প্রথম কয়েকদিন দৌঁড়াদৌড়ি করা লেগেছে জিডি অফিসে (এনআইডি হারিয়ে গেছে), নির্বাচন কমিশনের অফিসে (এনআইডি তোলার জন্য), পাসপোর্ট অফিসে (বর্তমানটা প্রায় মেয়াদোত্তীর্ণ) আর সেগুলোতে যাবার জন্য রাস্তাঘাটে। আদৌ কি সার্ভিস লোকমুখে শোনা পর্যায়ের খারাপ এখনো? পদে পদে কি টাকা চায় লোকেরা? নাকী কাজ কোন মামা চাচা টাকা ছাড়াই হয়ে যায়? প্রিয় পাঠক বা পাঠিকা আমার, সেগুলো নিয়েই আমার এই লেখার আলাপ সালাপ! বলাই বাহুল্য, নেহাৎ প্রয়োজন ছাড়া আমি আমার পেশাগত পরিচয় কোথাও দেই না। কোথাও আমার পরিচয় দিতে হলে সেটা আমি লেখায় আলাদা করে উল্লেখ করেছি। এই আলাপসালাপ একান্তই একজন সাধারণ, “আপনি আম্রে চেনেন?” না বলা বাঙ্গালীর দৃষ্টিকোণ থেকে*। :)

বিমানবন্দর

বিমানবন্দর নিয়ে সবার খুব ভয় - কাস্টমস এর জন্য, আরো কী না কী! আমার অভিজ্ঞতা বলি - বিমানবন্দরে নেমেছি সকাল ৯টায়, বার হয়েছি ২টার দিকে সব শেষ করে। এত সময় লাগলো কেন? ৩ বা সাড়ে ৩ ঘন্টা লেগেছে কভিডের পিসিআর নেগেটিভ টেস্ট দেখাতে, ১ বা ১.৫সট ঘন্টা লেগেছে তারপর ইমিগ্রেশনে। এত সময় লেগেছে কারণ ঐদিন আমাদের ফ্লাইটের সাথে আরো ৪টা ফ্লাইট নেমেছে, সবগুলো মিডল ইস্ট থেকে, খেটে খাওয়া বাঙ্গালিদের নিয়ে। লোকমুখে শুনেছি “ওমিক্রন কভিড” এর কারণে নাকি সব রাতের ফ্লাইট দিনে নিয়ে আসায় হঠাৎ করেই চাপ বেড়ে গেছে। আমাদের সাথে আসা বাঙ্গালিদের বেশিরভাগ পড়তে বা লিখতে পারেন না। নিজের চোখে দেখেছি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বা ইমিগ্রেশন অফিসাররা এই বাঙ্গালিদের ফর্ম নিজেরা পূরন করে দিচ্ছেন, তাতে প্রতি জনের জন্য অনেক বেশি অতিরিক্ত সময় লাগছে। এই খেটে খাওয়া বাঙ্গালির জন্য যদি অতিরিক্ত সময় লাগে, তবে আমি তাই সই। আরেকটা মজার জিনিষ দেখেছি - এক একটা ব্যুথের লাইন তো বিশাল - সেখানে কেউ লাউন ভেঙ্গে আগাতে চাইলে লোকজন হইহই করে; তাও লাইনে কেউ না কেউ ঢুকে যায়। তবে মহিলারা কেউ আগাতে চাইলে লোকজন আবার যায়গা ছেড়ে দেন, বলেন, “যান যান, আগায় যান, আপনারা আগে শেষ করে ফেলেন“। খেটে খাওয়া মহিলাদের প্রতি খেটে খাওয়া পুরুষদের এইটুকু শ্রদ্ধা চোখে পড়ার মতো।

এরাইভাল ইমিগ্রেশন: ছোট দুইটা সমস্যা হয়েছে। একটা হচ্ছে এরাইভালের ফর্ম শেষ হয়ে গিয়েছিলো। অফিসারকে জিজ্ঞাসা করতেই উনি বললেন ডিপারচারের ফর্ম নিয়ে কেটে এরাইভাল লিখে দিয়ে দিতে। উনার হাতে অবশ্য আর কিছু করার ছিলোও না - এরাইভাল ফর্ম তো আর উনি নিয়ে বসে থাকবেন না। আরেকটা হচ্ছে আমার পাসপোর্ট থেকে তথ্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না; কারণ ঐটার আগের পাসপোর্ট দিয়ে নাকী আমার তথ্য ঢুকানো হয়েছিলো। কী একটা অবস্থা!

কাস্টমস: আমি বলেছি ভাই, কতক্ষন লাগবে? কী করতে হবে? আমাকে পাল্টা প্রশ্ন: কই থেকে এসেছেন? আমি: আমেরিকা থেকে। অফিসার বললেন, “দেখেন, কিছু মনে করিয়েন না; বাংলাদেশে বেশিরভাগ মদ বিদেশ থেকে নিয়ে আসেন শিক্ষিত বাঙ্গালিরাই, তারা কাস্টমস এ ডিক্লেয়ারও করেন না। আপনি কাস্টমস এ লাগেজ চেক করতে দেন, মদ না থাকলে ১০ সেকেন্ডে আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। সোনা আছে ১০০ গ্রামের বেশি?” আমি, “একদমই না!”। আর কোন কথা নাই, ১০ সেকেন্ডে লাগেজ স্ক্যান করেই ছেড়ে দিলো।

সবমিলিয়ে আমার মনে হয়েছে বিমানবন্দর যথেষ্ট উন্নত, আর মানবিক। আরো কিছু হয়তো লোক নেয়া যায় শুধুমাত্র ফর্ম ফিলাপ করার জন্য - তা না হলে অফিসারদের উপরে চাপ অনেক বেশি পড়ে যায়, সময়ও সবমিলিয়ে বেশি লাগে।

থানা

থানায় গিয়ে আমার একটু মন খারাপ লেগেছে। অন্ধকার, গুমোট, ভ্যাপসা গরম একটা পরিবেশ এই ডিসেম্বেরেও। কিন্তু ডিউটি অফিসার আমাক যথেষ্ট সাহায্য করেছেন জিডি করার জন্য, আমি থাকাকালীন সময়ে যারা এসেছেন তাদের সবাইকেও করেছেন - এর মধ্যে এক ইনফরম্যান্টও ছিলো! “স্যার স্যার! আপনারা যেই কিরিমনালরে খোঁজতেছিলেন হ্যায় আসছে বাসায়! খবর পাক্কা!” - মজাই লেগেছে এসব দেখে। আশা করি থানার পরিবেশ আরো ভালো হবে ভবিষ্যতে, ডিউটি অফিসাররাও ভালো পরিবেশ পাবেন।

নির্বাচন অফিস

নির্বাচন অফিসে গিয়ে একটু গোত্তা খাওয়া লেগেছে। এক ভবনেই যে দুই এলাকার নির্বাচন অফিস এটা আমি জানতাম না। কাজেই প্রথমে এক অফিসে গেছি, সেখান থেকে আরেক অফিস। অফিসের লাইনে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে করতে দেখলাম ওখানের অফিসাররা কাজ করছেন, যথেষ্ট আন্তরিক। এক বয়স্ক লোক অনেক কথা বলছিলেন কার্ড উঠানোর সময়, ওদিকে কাজগপত্র ঠিক নাই। বেচারা অফিসার না পারে কিছু বলতে, না পারে সইতে। এ অবস্থায় একসময় বলেই ফেললেন, “মুরুব্বী, আমি তো আপনারটাই দেখতেছি - আমারে একটু দেখতে দ্যান?“।

অবশ্য তার পরে সেখান থেকে জেনেছি আমার এলাকার নির্বাচন অফিস নাকি আরেক যায়গায়! সেখানে পরে আরেকদিন গিয়ে স্মার্ট কার্ড উঠিয়েছি। তবে এই অফিস বনেদী এলাকায় হলেও (মতিঝিল) অফিসের অবস্থা ছিলো তথৈচব - ধূলোময়, জীর্ণ দেয়াল মন খারাপ করিয়ে দেয়। নির্দেশনামূলক ব্যানার ছিলো না। তবে প্রিন্ট করা কিছু কাগজে ছিলো কোন কাজের জন্য কত নং টেবিলে যেতে হবে; যদিও টেবিলগুলোতে কোন নাম্বার আমি দেখিনি। কাজগুলোর জন্য যে কী লাগে, কী নিয়ে আসতে হয় তাও লেখা ছিলো না বলে অফিসারদের কাছ থেকে জেনে আবার অনেককেই সেই কাগজ যোগাড় করতে অন্য যায়গায় যেতে দেখেছি।

পাসপোর্ট অফিস

আমার পাসপোর্ট অফিস কেরাণীগঞ্জে। আমি তো চিন্তায় ছিলাম - ঐদিকের পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার রাস্তা পুরোই ভাঙ্গা, বিচ্ছিরি। দুই তিন বছর আগে নাকি আমার বাবা মায়ের যেতেই ৩ ঘন্টার মতো লেগেছে ভাঙ্গা রাস্তায়। সুতরাং তাড়াহুড়ো করে বার হয়েছি। ওমা, পুরো ১০ কিমি রাস্তা পার হলাম ১০-১৫ মিনিটে, কোথাও জ্যাম নাই। ফ্লাইওভারে উঠেছি আর নেমেছি। আমার বাবা একটু পর পরই বলছিলো, এইটা কী! পুরাই বিদেশের রাস্তা! আমিও দাঁত কেলিয়ে ছিলাম পুরো রাস্তা!

এই একটা মাত্র যায়গায় আমার পরিচয় দিতে বাধ্য আমি, এবং দিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে পাসপোর্ট রিনিউ করানোর জন্য NoC দিতে হয়। এখানের অফিসাররা অবশ্য একটু অনভিজ্ঞ, কারণ NoC থাকলে কিছু সুবিধা থাকে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য (ডিফল্ট ডেলিভারি মেথড এক্সপ্রেস হয়ে যায়) তবে ঐ অফিসের অফিসার সেটা জানতেনই না। কাজেই আমার পাসপোর্টের ডেলিভারি রেগুলার হবে। একই দিনে আমার আরেক সহকর্মী অবশ্য আগারগাঁও এর পাসপোর্ট অফিসে অবশ্য এক্সপ্রেস ডেলিভারির তারিখই পেয়েছেন।

আপডেট: আমি পাসপোর্ট তৈরি হয়েছে এসএমএস পাবার দুই দিন পরেই পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ডেলিভারি স্লিপ দিয়ে পাসপোর্ট তুলে নিয়েছি। ডেলিভারি স্লিপ দিয়ে পাসপোর্ট নিতে একটু সময় লাগে, অনেকেই লাইনে থাকেন বলে - কিন্তু ঐ সময় লাগা বাদে আর কিছু লাগেনি। 😄

সবমিলিয়ে

সবমিলিয়ে আমার মনে হয়েছে দেশের সার্ভিসগুলো এখন যথেষ্ট ভালো হয়েছে। ওয়েবসাইটে নির্দেশিকা তো থাকেই, সাথে অফিসগুলোতেও যথেষ্ঠ পরিমাণ নির্দেশিকা টাঙ্গানো, ঝুলানো, বা সাঁটানো থাকে পোস্টারে, কাগজে বা আঁকুনিতে। সিঙ্গাপুরের ভ্রমনকাহিনীতে লিখেছিলাম, হয়তো পড়েছেন আপনি, ওখানেও একই জিনিষ লক্ষ্য করেছি। সকল নির্দেশিকা লেখা থাকে, কাজেই কী করা লাগবে এটা নিয়ে কারো কোন অজ্ঞতা থাকে না। লোকজন নির্দেশিকা অনুসারে কাজ করলেই হয়ে যায়, অন্য ঝামেলার বালাই নেই।

  • এই লেখাটা পুরোপুরি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা। সঙ্গত কারণেই আপনার অভিজ্ঞতা মিলতেও পারে, নাও পারে।

First, click on "Comments" below to view/post comments.
To comment as guest, click on the field "Name". The option to do so will become visible.
লগইন ছাড়াই কমেন্ট করতে নাম এ ক্লিক করুন, দেখবেন তার নিচেই আছে অতিথি হিসাবে কমেন্ট করার অপশন।