আইআইটি এবং আন্তর্জাতিক গবেষক প্রোগ্রামের আদ্যপান্ত
একটা খুব ভালো খবর সবার সাথে ভাগাভাগি করি 🎉। আশা করি আমার আনন্দে আপনারাও আনন্দিত হবেন।
আইআইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গত বছর তাদের ৮ম সেমিস্টার (৪র্থ বর্ষের) ফাইনাল গবেষণাধর্মী প্রোজেক্ট সম্পন্ন করেছে Software Engineering এর গবেষক প্রফেসর ডঃ ডেনিস পশিভানিক, সাইবার সিকিউরিটি এর গবেষক প্রফেসর ডঃ অদ্বৈত নাদকারনি এর সাথে। সেই প্রোজেক্টের মাধ্যমে তারা গবেষণা এর ব্যাপারে জেনেছে, শিখেছে, আর কাজ অনুসারে উচ্চশিক্ষার জন্য পেয়েছে তাদের রিকমেন্ডেশন লেটার। সেই কাজ থেকে গবেষণার পেপার পাবলিশ হলে তাদের নাম তো থাকবেই অন্যতম লেখক হিসাবে! সেই কাজগুলো সাবমিশনে ছিলো বা আছে। প্রকাশিত হলে আরেক ব্লগে আসবে। 😁
এটা সম্ভব হয়েছে আইআইটি এর শিক্ষকদের এবং আমার এডভাইজরদের সহযোগিতায়, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশের বাইরের গবেষকদের সাথে কাজ করার স্বদিচ্ছার কারণে।
আজকের আলাপ এই প্রোগ্রাম কীভাবে হলো, আর প্রোগ্রাম করার সময় কী কী খেয়াল রাখা লেগেছিলো তা নিয়ে।
২০১৯ এ যার শুরু
তখন পিএইচডিতে মাত্র ২য় সেমিস্টার চলছে আমার। ফ্যাকাল্টি হিসাবে জয়েন করেছে অস্কার শাপারো, তার এডভাইজর আবার ডেনিসেরও এডভাইজর। খেয়াল করলাম তখনই - অস্কার কলম্বিয়ার যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলরস করেছে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে প্রায় প্রতি বছর অন্ততঃ একজন শিক্ষার্থী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংএ পিএইচডি করতে ডেনিসের ল্যাবে ঢুকে। এটা নিশ্চয়ই কাকতালীয় না, পাইপলাইন তো আছে নিশ্চিত! কিন্তু কেমন সেই পাইপলাইন? কাহিনী কী? অস্কাররে জিজ্ঞাসা করতেই সে বললো, এটা হয়েছে ডেনিসের সাথে পিএইচডি করা বেশ সিনিয়র একজনের কারণে, মারিও। মারিও ডেনিসের সাথে পিএইচডি করার পরে তার দেশে, কলম্বিয়ায়, ফেরত যায়, এবং তার সাথে কাজ করা শিক্ষার্থীরা ম্যাচ করলে (মানে গবেষণায় ভালো, উৎসাহ আছে, কাজের ধরণ মিলে - ইত্যাদি) তাদের সে ডেনিসের কাছে রিকমেন্ড করে, আর তারপরে ভর্তি কমিটির পছন্দ হলে সেই শিক্ষার্থী এখানে পড়াশুনা করতে আসে।
আমি ভাবলাম, ‘ব্যাপারডা ভালো, পছন্দ হৈসে। কিন্তু আরো ভালো চাই।’
আইআইটিতে গবেষণা হচ্ছে না এমন না; মাস্টার্স এ হচ্ছে, ব্যাচেলরস এ ৮ম সেমিস্টারের প্রোজেক্টেও হচ্ছে। টপ টিয়ার কনফারেন্স জার্নালে বছর বছর পেপার পাবলিশও হচ্ছে। কিন্তু তাতে শিক্ষার্থীদের আইআইটি কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা গবেষণার সাথেই কেবল পরিচয় হচ্ছে, আশেপাশেও তো তাকানো লাগবে। সেই তাকানোর জন্য যদি ভালো র্যাংকওয়ালা গবেষকদের সাথে কাজ করার সুযোগ মিলে, আর ভবিষ্যতে পিএইচডি করার রাস্তাটা সহজ হয় - তাহলে তো সোনায় সোহাগা! সেরকম কিছু একটাই করা দরকার।
২০১৯ - ২০২১ এর অপেক্ষা
২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত তক্কেতক্কে ছিলাম। সরাসরি যদি ৮ম সেমিস্টারের প্রোজেক্ট এ দেশি বিদেশি গবেষকদের মেন্টর বানাতে চাই, সেই গবেষকদের লাভ কী? এই বিষয়ে পটানো লাগলে তো আগে বলার মতো নিজের যোগ্যতা লাগবে।
সুতরাং, অপেক্ষায় রইলাম নিজের প্রোফাইল শক্তপোক্ত করার জন্য, যেন তারা প্রস্তাব দিলো সেটা গুরুত্বের সাথে নেয়।
আফটারঅল, নিজের যোগ্যতা আগে।
২০২১ এর নকশাচাল
২০২১ এ হঠাৎ করেই চোখে পড়লো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চাইছে দেশি বিদেশি গবেষকদের গবেষণা, শিক্ষকতা কার্যক্রমে জড়িত করতে। আমারো মাঝে দিয়ে কয়েকটা ভালো গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে, সাথে ২টা ডিসার্টেশন ফেলোশিপ, ১টা পলিসি ফোলোশিপ, একটা ডিপার্টমেন্টাল ফেলোশিপ, প্রায় এক-দেড় ডজন আন্ডারগ্র্যাড স্টুডেন্টদের আমার এডভাইজরদের তরফ থেকে মেনটরিং বা প্রোজেক্টের জন্য ম্যানেজ করা, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিমন্ত্রিত গবেষণা বক্তা হয়ে কথা বলা হয়ে গেছে। আর পিএইচডি ক্যান্ডিডেট হিসাবে আমি তখন গবেষণা সহকর্মী আমার এডভাইজরদের, এর মানে তাদের সাথে কাজ করি, তাদের কথায় না।
সুতরাং, এখনই সময়!
আলাপ শুরু করলাম, আগে আইআইটি এর শিক্ষকদের সাথে আলাপ করা শুরু। কারণ এখানের কেউ মেন্টর হতে রাজি হলো, কিন্তু শিক্ষার্থী নাই - তাহলে হবে কেঁচে গণ্ডুষ। সুতরাং আলাপ করলাম আইআইটি এর ডিরেক্টর, আন্ডারগ্র্যাড প্রোগ্রামের চেয়ার আর ৪র্থ-বর্ষ কমিটি চেয়ারের সাথে। সবার পেলাম সমর্থন, আর তারপরে এডভাইজর আর আইআইটি এর সমন্বয়ে পরিষ্কার করলাম নিচের বিষয়গুলো একটা লিখিত গাইডলাইনের মাধ্যমে। তার চুম্বক অংশগুলো অনেকটা এরকম:
- প্রোজেক্টের প্রস্তাবনা: এটা হবে আইআইটির আর আন্তর্জাতিক গবেষকদের (এখানে গবেষক = প্রফেসর) সমন্বয়ে। প্রত্যেক আন্তর্জাতিক গবেষক অন্ততঃ একটা সেশন নিবেন, যেখানে তাঁরা বলবেন তাঁদের সাথে কাজ করলে শিক্ষার্থীরা কী শিখতে পারবে, আর কীসে কাজ করবে। সেই আলাপে Non-Disclosure Agreement এর ব্যাপারও থাকতে পারে, কারণ নিদেনপক্ষে গবেষণার কাজ প্রকাশ হবার আগেই সবাই জেনে যাক এটা কেউই চায় না।
- প্রোজেক্টের বিস্তারিত: আন্তর্জাতিক গবেষক প্রোজেক্টের কাজ, পরিধি ইত্যাদি আগেই অবহিত করবেন সেশনের আগেই। তাতে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা সেশনের আগেই সারাংশ জেনে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তারা সেটায় আগ্রহী নাকি। প্রোজেক্টেটা আন্তর্জাতিক গবেষক এবং আইআইটির গবেষকেরা মিলেও সেটা করতে পারেন। তবে এটা তাঁদের ইচ্ছার উপরে, কারণ দুম করে চাইলেই দুই দেশের গবেষকেরা যৌথভাবে গবেষণা শুরু করতে হয়তো পারবেন না। শিক্ষার্থীরা শিখবে, সেই শেখা থেকে জানা, পরিচয়, তারপর যৌথভাবে গবেষণা এর সুযোগ তৈরি হবে নিজে থেকেই।
- ম্যাচমেকিং: সেশনগুলোর শেষে শিক্ষার্থীরা যে আন্তর্জাতিক গবেষক এর সাথে কাজ করতে চায় সে বিষয়ে আইআইটিকে অবহিত করবে, এবং আইআইটি তারপরে আলাপ করবে সেই আন্তর্জাতিক গবেষক এর সাথে শিক্ষার্থীর বিষয়ে।
- দেশের থেকেও মেন্টরিং: কোলাবোরেশন হোক বা না হোক, আইআইটি থেকে একজন গবেষক থাকবেন শিক্ষার্থীকে মেন্টর এবং/অথবা ম্যানেজ করার জন্য। শিক্ষার্থী দুম করেই একজন আন্তর্জাতিক গবেষক এর সাথে কাজ শুরু করতে গেলে নানা সমস্যায় পড়তেই (বা ফেলতেই) পারে, সেটা কমিউনিকেশন গ্যাপ হোক বা আর কিছু। সেগুলোর জন্য আইআইটির দিক থেকে একজন গবেষক থাকবেন শিক্ষার্থীর মেন্টর হিসাবে।
- সবশেষে ফলাফল: আর অবশ্যই, আন্তর্জাতিক গবেষক সেমিস্টার শেষে ফিডব্যাক দিবেন আইআইটিকে, যেটার সাহায্যে শিক্ষার্থীকে গ্রেডিং করা হবে। কাজ ভালো হলে আন্তর্জাতিক গবেষকদের তরফ থেকে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির জন্য রিকমেন্ডেশন লেটার, আর পেপার এ অথর হিসাবে নাম থাকার সুযোগ থাকছে। আর শিক্ষার্থীদেের কোন বাধ্যবাধকতা নেই এডভাইজরের বিশ্ববিদ্যালয়েই এপ্লাই করার জন্য, দুই পক্ষের জন্যই রাস্তা খোলা!
মোদ্দা কথা, এমন একটা প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে - যেটায় সবাই জিতবে। 🙌
আর কলম্বিয়ার সেই পাইপলাইন এর সাথে এই পাইপলাইনের পার্থক্যটা হচ্ছে, ওখানে পাইপলাইন ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এখানে পাইপলাইন ইনস্টিটিউট আর গবেষণাল্যাব কেন্দ্রিক। ভবিষ্যতে MoU বা আর কিছু হলে ব্যক্তি না থাকলেও পাইপলাইন থেকে যাবে।
এইতো! গত বছর এই প্রসেসে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার আবেদনে রিকমেন্ডেশেন লেটার লিখেছেন আমার দুই এডভাইজর, আর আমার জানামতে তারা সবাই ভালো র্যাংকওয়ালা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরো ফান্ডিং সহ ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।
এরপরে কোথায়?
আইআইটিতে গতবছর এটা পরীক্ষামূলক ভাবে চালু হয়েছে মাত্র ২ জন আন্তর্জাতিক গবেষকদের মেন্টরশিপ দিয়ে। এটা বড়সড় পরিসরে করতে হলে, গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সবাইকে আন্তর্জাতিক গবেষকদের মেন্টরিং এর সুযোগ দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটা পুল লাগবে। আর প্রতি বছর একই গবেষক মেন্টরিং করবেন সেটা আশা করাও সম্ভব না। তবে সেই বড় পুল একজনের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব না। আইআইটি থেকে পড়াশুনা করে তারপরে আমার মতোই পিএইচডি করছে এরকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম না। আইআইটিয়ান ফ্যাকাল্টি ছিলো, এখন নিজেরাই আন্তর্জাতিক গবেষক হয়ে গেছেন এরকমও আছেন অনেকে। তাদের সবারই এগিয়ে আসা লাগবে।
এরকম যখন একবার করা গেছে, আরো করা যাবে। খালি আইআইটিতে না, ধীরে ধীরে সব খানেই। কিন্তু সেটা করার জন্য সবার একটু এরকম কথা বলা লাগবে, নিজের এডভাইজরের সাথে, নিজের এলামনাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে।
এইতো! 🙂
To comment as guest, click on the field "Name". The option to do so will become visible.
লগইন ছাড়াই কমেন্ট করতে নাম এ ক্লিক করুন, দেখবেন তার নিচেই আছে অতিথি হিসাবে কমেন্ট করার অপশন।