মনোযোগ আর একাগ্রতা - সোশ্যাল মিডিয়ার পৃথিবীতে আমি যেভাবে অনুশীলন করি

Written on January 4, 2022 , Last updated on: January 18, 2022

পূ্র্ব আলাপ

২০২১ সাল - আমেরিকার কোন এক বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত গবেষণা আলোচনায় নিমন্ত্রিত বক্তা মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কাজ করেন ফেসবুকে; প্রশ্ন করেছিলেন আলোচনায় অংশ নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের - যারা নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করেন তারা যেন হাত তুলে। রুমে ৫০-৬০ জনের মাঝে একজনও হাত তুলে নাই।

আমেরিকায় আমি গবেষণা করছি এবং পিএইচডির পিছনে ছুটছি প্রায় বছর চারেক হচ্ছে। এসময়ে আমি ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম জাতীয় সামাজিক মাধ্যমে দেশি বিদেশি খুব কম সহশিক্ষার্থী আর গবেষকদের একটিভ থাকতে দেখেছি। কারণটা খুব সহজ: গবেষণা করতে একাগ্রতা লাগে, মনোযোগ লাগে, লাগে একনাগাড়ে লেগে থাকা।

আমরা যারা কম্পিউটার সায়েন্সের গবেষণায় আছি - তারা আরো ভালো জানি, ফেসবুক এবং এ জাতীয় সকল মাধ্যমগুলো বিশাল পরিমাণে বিনিয়োগ করে তাদের সিস্টেমে। সেই সিস্টেম প্রতিটা মানুষকে তার পছন্দের কনটেন্ট, ভিডিও ইত্যাদি দেখায়, যেন ব্যবহারকারী আরো মনোযোগ দেয়, আরো সময় দেয়, আরো আরো আরো বেশি জড়িয়ে যায় এসবে।

সমস্যা হচ্ছে এগুলো ব্যবহার করার অভ্যাস আপনার মগজেও পরিবর্তন ঘটায়। কীভাবে এগুলো পাকাপোক্তভাবে আপনার একাগ্রতা নষ্ট করে দেয়, মনোযোগের সময় কমিয়ে আনে এগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা আছে, হচ্ছে, হবে - সেগুলো নিয়ে আপনি পড়তে পারেন বা শুনতে পারেন অনেক যায়গাতেই। ড: কাল্ নিউপোর্ট, কম্পিউটার সায়েন্স গবেষক, এর একটা ভিডিও বক্তব্য আপনারা শুনতে পারেন যেখানে উনি ফেসবুক জাতীয় মিডিয়াগুলো কীভাবে মানসিক ক্ষতি করে সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলাপ করেছেন। ১০টা মিনিট খরচ করে এটা দেখেন, জীবনের কাজে লাগবে অবশ্যই।

কী কইত্তাম?

ফেসবুক ফেলাইতে পারবো না, সারাদিন মেডিটেশনও সম্ভব না!

মিডিয়ার খারাপ দিক নিয়ে, মনোযোগ অনুশীলন নিয়ে বেশিরভাগ কনটেন্ট যা আছে সেগুলো আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য না বা প্রয়োগ করাও কঠিন। যেমন কেউ আমাকে যদি বলে ফেসবুক ডিএকটিভ করে ফেলেন - আমি তারে চোখ উল্টায়ে বলবো অসম্ভব! আমার বাবা মা দেশে থাকে, আত্মীয় স্বজনও নানা দেশে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রুপও ফেসবুকে। সেখানে নানা জরুরী খবর মাঝে মাঝেই থাকে। না পেলে আমারই তো ক্ষতি! তার উপর ফেসবুক ছিলো বলে আমি সময়মতো জানতে পেরেছি হুট করে বাংলাদেশের নিয়ম পাল্টেছিলো ওমিক্রনের জন্য - ফেসবুক না থাকলে দেশে আসার পরে তো আমার বউসহ ১৪ দিন কোয়ারান্টাইনে থাকা লাগতো নিজ খরচে। ক্যামনে কী!?

সুতরাং আমি আলাপ করবো আমি নিজে যা করি মনোযোগ আর একাগ্রতা ধরে রাখতে - ফেসবুক সহ নানা সোশ্যাল মিডিয়াতে থেকে, সাদা কালোর মাঝের ছাই রঙা এই পৃথিবীতে। আপনি হয়তো সবগুলো হুবহু করতে পারবেন না, হয়তো আরো বেশি করতে পারবেন।

এই গাইডলাইনটা থাকলো - আপনার আমার রেফারেন্সের জন্য।

যেভাবে আমি মনোযোগ এবং একাগ্রতা অনুশীলন করি

সবার আগে আপনার আমার একটা জিনিষ বুঝা দরকার। আমি বড় হয়ে গেছি, সুতরাং আমাকে আমার নিজের দায়িত্ব নিতে হবে। আগের মতো বকাঝকা করে কেউ আমাকে নিয়ন্ত্রন করবে না বা লাইনে আনবে না। কিন্তু নিজের দায়িত্ব নেয়া অবশ্যই কঠিন। সেটার জন্য আমি কিছু সফটওয়্যারের আর প্র্যাকটিসের সাহায্য নিয়েছি যেন সেগুলো আমার দায়িত্ব নেয়, আমাকে লাইনে রাখে। কিন্তু নিজেই যদি সেই সফটওয়্যার ফেলায়ে দেই বা অফ করে দেই, তাহলে তো আর লাভ নাই। সুতরাং, আগে নিজের সেটআপ করা সফটওয়্যারের প্রতি বা প্র্যাকটিসের প্রতি নিজের কমিটমেন্ট সবার আগে আনতে হবে।

এইটুকু মনে রেখে আমি পরের কাজগুলো করি।

পুশ মেথড বাদ দিয়ে পুল মেথডে আসুন

প্রথমেই আপনার যেটা বুঝতে হবে সেটা হচ্ছে এটেনশন নেবার এবং আনস্মার্ট বানানোর সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হলো আপনার পকেটের স্মার্ট ডিভাইসটা। এই ডিভাইসটা রাত দিন আপনাকে নোটিফিকেশন পুশ করে (বা ঠেলে) এটেনশন নিয়ে নেয়। আমি পুল (বা নিজে টেনে নেবার) মেথডে নিয়ে এসেছি এটা। কীরকম?

  • ফেসবুক: আমি মোবাইলে ফেসবুকের অ্যাপ ফেলেই দেই সেমিস্টার শুরু হলে কারণ এটা আমার সবচেয়ে বেশি মনোযোগ নেয়। এই ছুটির সময় অ্যাপ ইন্সটল করেছি এখন কোন কাজ নাই এজন্য। বিদেশ যাবো, অ্যাপ ফেলে দিবো। তবে ম্যাসেঞ্জারটা রেখেছি - কারো কোন জরুরী দরকার হলে কল দিতে পারে। ফেসবুক ব্যবহার করতে ইচ্ছা করলে ব্রাউজার চালাই - তবে সেটায় আরো কিছু কেরামতি করেছি। পড়তে থাকুন, বলছি।
  • অন্যান্য অ্যাপ: আর যেসব অ্যাপ থাকে (যেমন টুইটার - এটা একেডেমিশিয়ানরা অনেকেই ব্যবহার করে, আমি প্রায়ই নানা গবেষণার সন্ধান পাই এটা থেকে) সেগুলোর নোটিফিকেশন সাইলেন্ট থাকে মোবাইলে। কিচ্ছু আসে না বা শব্দ করে না। ফ্লোটিং নোটিফিকেশন তো আরো আগেই অফ! এন্ড্রয়েডে আপনি এটা কনফিগার করতে পারেন চাইলেই অ্যাপের সেটিংস থেকে বা নোটিফিকেশন সেটিংস থেকে। ট্যাগ টুগ দিলে তাও নোটিফিকেশন আসে - কিন্তু সেটা মাসেও একবার নাকি সন্দেহ। নিজের যখন ইচ্ছা হয়, ঢুকি, তারপর আবার বার হয়ে যাই।

সময় নিয়ন্ত্রিত ভাবে মিডিয়াতে দেয়া

ভ্যাজাল হচ্ছে ছোটবেলায় বাবা মা খুব বেশি সময় টিভি দেখলে বকাঝকা দিয়ে উঠিয়ে দিতো। বড় হবার পরে সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য সেটা কে করবে? এ্যালার্ম দিতে আলসেমি লাগে, আবার সবসময় তো ঘড়ি ধরে দেখাও যায় না। তাই না?

দেখাচ্ছি ক্যামনে করি:

  • ব্রাউজার প্রোফাইল: ব্রাউজারে আমার দুইটা প্রোফাইল। একটা কাজের, আরেকটা অকাজের। কাজের প্রোফাইলে আবার অকাজের কোন সাইটে আমি লগইন ই করি নাই। সুতরাং চাইলেও ওটা থেকে আমি অকাজের সাইটে সময় দিতে পারবো না। ক্রোম ব্রাউজারে প্রোফাইল সেটআপ করার জন্য এই অফিশিয়াল গাইডলাইন দেখতে পারেন। ফায়ারফক্স বা অন্য ব্রাউজারেও একই সুবিধা আছে। ব্রাউজারে না পারলে নিজের কম্পিউটারে দুইটা ইউজার বানিয়ে ফেলেন!
  • সময় নিয়ন্ত্রন: অকাজেরটায় আবার StayoFocusd নামের একটা এক্সটেনশন ইন্সটল করেছি। আপনিও পারবেন ক্রোম বা এ জাতীয় ব্রাউজারে এটা ইন্সটল করতে। ফায়ারফক্সের জন্যও একই রকম অ্যাপ বা এক্সটেনশন আছে। এটায় আমি কনফিগারেশন করে রেখেছি এভাবে: সারাদিনে আমি যখনই ফেসবুক বা অন্য ব্ল্যাকলিস্টেড সাইট চালাই - এটা সবগুলো সাইট মিলিয়ে আমাকে সর্বমোট ১০ মিনিট দেখতে দিবে। সুতরাং হয়তো আমি ফেসবুক চালাবো ৫ মিনিট, ইন্সটাগ্রাম চালাবো ৫ মিনিট। এর বেশি হলে সারাদিনের জন্য ঐসব সাইট ব্লকড হয়ে যাবে নিজে নিজেই।
  • আনইন্সটল ব্লক করা: যদি নেহাৎ এমন অবস্থা হয় যে আপনি নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রন করতে পারেন না, দুমদাম সব আনইন্সটল করে ব্রাউজ করতে চান; সেক্ষেত্রে একটা ফ্রি অ্যাপ আছে, Cold Turkey যেটা আনইন্সটল করাও ব্লক করে দেয়। আরো কিছু অ্যাপ আছে যেগুলো কিনতে হয় টাকা দিয়ে। এটা দিয়ে চেষ্টা করতে পারেন। তবে তার আগে ভেবে দেখবেন, আপনি যদি নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ সত্ত্বাকে আটকাতে না পারেন, অ্যাপগুলো কি পারবে?

Pomodoro আর নিজেকে মনিটর করা

Pomodoro: আমি পোমোডোরো টেকনিকের ভক্ত। যে কাজ করতে ভাল্লাগে না সে কাজ একমনে জন্য পোমোডোরো কাজে দেয় আমার; আর যে কাজ করা দরকার, ভাল্লাগে সেগুলো তো করার জন্য পোমোডোরো লাগে না। করতেই থাকি, করতেই থাকি!

খুব সহজে বললে পোমোডোরো টেকনিক এভাবে প্রয়োগ করি আমি:

  1. কাজটা কী ঠিক করি
  2. স্টপ ওয়াচ বা টাইমার নিয়ে বসি (না থাকলে ব্রাউজারেই আছে; অথবা মোবাইলে Forest)
  3. ২৫ মিনিট একাগ্র চিত্তে, একমনে অন্য কিছু না করে খালি ঐ কাজটাই করি
  4. ৫ মিনিট বিরতি - এসময়ে ফেসবুক বা অন্য যা মন চায় করতে পারি
  5. আবারো ২৫ মিনিট কাজ
  6. আবারো ৫ মিনিট বিরতি
  7. আবারো ২৫ মিনিট কাজ
  8. এবার ১৫ মিনিট বিরতি
  9. এক নাম্বার স্টেপ থেকে আবারো

এমন না যে ঠিক ২৫ মিনিটই কাজ করতে হবে। হয়তো কাজটা মাঝে থামানো যাবে না এজন্য ৩০ মিনিট করতে হতেই পারে! কিন্তু ৫ মিনিট বিরতি মানে ৫ মিনিটই, এর বেশি এক সেকেন্ডও না। আমি টাইমারের টিক্ টিক্ ঘড়ির শব্দটা শুনি। আগে থেকেই এভাবে টিক্ টিক্ শব্দের মাঝে কাজের অভ্যাস বলে শব্দটা শুনলেই নিজে নিজে কাজ করার মানসিকতা চলে আসে।

নিজেকে মনিটর করা: আমি অনেক সময় মন অস্থির থাকলে পাশে একটা কাগজ কলম রাখি। কাজের মাঝে অন্য কিছু করলে বা ভাবলেই কাগজে লিখে ফেলি সেটা কী। তারপরে আবার আগের কাজে ফেরত আসি। লিখলে কয়েকটা কাজ হয় -

১) সচেতন হই, নিজের মনোযোগ আবার কাজের বিষয়ে নিয়ে আসতে পারি;

২) সেটা যদি আসলেই কাজের কাজ হয় তাহলে আর মনে করা লাগে না। লেখাটা পড়ে কাজটা করে ফেলি; আর

৩) মনোযোগ কীসে চলে যাচ্ছে সেটা লিখিত আকারে থাকে। সপ্তাহ বা মাস শেষে সেগুলো দেখে আরো পদক্ষেপ নিতে পারি যেন আমার কাজে এগুলো ঝামেলা না করে।

এগুলো ছাড়াও আমি দুইটা জিনিষ সব সময় মনে রাখি বা মানার চেষ্টা করি:

বিশ্রাম মানে বিশ্রাম! সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটানো না

দেখেন, অনেকের ধারণা দিনশেষে একটু মোবাইল গুঁতালে, মিডিয়া ঘাটলে মানসিক শান্তি লাগে, বিশ্রাম হয়। ব্যাপারটা তা না। আপনি কাজের সময়ও যেমন তথ্য নিচ্ছেন, আর সেগুলো মানসিক ভাবে বিশ্লেষন করে ক্লান্ত হচ্ছেন - ফেসবুক ঘাটার সময়েও তাই। খালি আপনার ভাল্লাগে বলে টের পান না, যদিও ভিতরে ভিতরে ঠিকই অস্থিরতা বাড়ে, বাড়ে মানসিক পরিশ্রমও।

একারণেই আমার সারাদিনে (বিশ্রাম + কাজের) মাঝে সর্বমোট বরাদ্দ সময় ৪০ মিনিট ফেসবুক এবং অন্য মিডিয়া মিলিয়ে। কারণটা খুব সহজ। দিনশেষে আমি যখন মানসিক ভাবে ক্লান্ত আমি তখন চুপচাপ বসে থাকবো, চিন্তা করবো, গল্প করবো, বা হয়তো বই পড়বো। এগুলোর প্রতিটা আমার নিয়ন্ত্রনে: আমি কতক্ষন করবো। ফেসবুক বা মিডিয়া সেটা ধরে রাখার চেষ্টা করবে। কিছু জিনিষ দেখাবে যেগুলো আমার ভালো লাগবে, কিছু আমাকে দুঃচিন্তা দিবে, কিছু রাগাবে। কিন্তু সেগুলোর নিয়ন্ত্রন আমার হাতে নাই।

সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া সময় কাটানো যায়

সোশ্যাল মিডিয়ার বয়স ২০ বছরও হয়তো হবে কোনমতে। খালি খ্রিষ্টিয় বছর গোনার হিসাবেই মানবজাতির ইতিহাস ২০০০+ বছর। তখন মানুষ সময় কাটাতে পারতো, এখনো পারে। আমিও পারবো। খালি দরকার একটু চেষ্টা, একটু সদিচ্ছা (আর উপরের সবগুলো কাজ করা)। সবসময় সময় কাটানো লাগবে এমনও তো না! কী হয় একটু বিশ্রাম নিলে? একটু নিজের জগতে সময় দিলে? আমার নিজেরই লাভ হবে তাতে।

শেষ কথা

দিনশেষে অনুশীলন অভ্যাসের বিষয়। আপনি ছোটবেলায় হাঁটতে পারতেন না, সেটা অনুশীলন করে শিখেছেন। এখন আমাকে ৫ কিমিঃ দৌঁড়াতে বললে আমি ১ কিমিঃও হয়তো দৌঁড়াতে পারবো না, হাঁপিয়ে যাবো - কারণ অনুশীলন নাই। একাগ্রতা, মনোযোগ এগুলোও অনুশীলনের বিষয়, খাদ্যাভাস এর মতোই।

এগুলো প্রথম দিন থেকেই হুট করে হবে না, আর আপনি সারাদিনে ২০ মিনিট মেডিটেশন করে একাগ্রতার অভ্যাস করলে সেটা বাকি ১২ ঘন্টা যে অমনোযোগী থাকেন সেটাও ঠিক করবে না। এগুলো আপনার সারাদিনই করা লাগবে, সবসময়ই।

প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, হয়তো এগুলোর সবগুলোই আপনি করেন। হয়তো আপনার পরিস্থিতি এমন যে এগুলো করা সম্ভব না। বা হয়তো কোনটা কোনটা আপনি করেন, কোনটা করেন না, পছ্ন্দ না বলে। আমি জানতে চাই, আলাপ করতে চাই এসব নিয়ে। অপেক্ষায় রইলাম আপনার মন্তব্য, প্রশ্নের, সমালোচনার - হোক সেটা এই ব্লগেই, বা ফেসবুকে, বা অন্যখানে।

একাগ্রতার অনুশীলনে আপনার জন্য শুভকামনা। :sunflower: