আমেরিকায় আসার আগে যা যা জানা দরকার - পর্ব ১
ধরে নিচ্ছি আমেরিকায় আপনি যাবেন, ফুল বা পার্শিয়াল ফান্ডিং নিয়েই। আগে আলাপ করেছি যা যা শেখা দরকার সে বিষয়ে, একাডেমিক দিক থেকে। কিন্তু একাডেমিয়াই তো সব না, সাথে জীবন আর যাপনেরও ব্যাপার আছে। প্রথমবার আমেরিকায় যাচ্ছেন, কী নিবেন? কী নিবেন না? কী জানা দরকার? সেটা নিয়েই এই লেখাটা।
মোবাইল ফোন
আসার আগে সবাই যে ভুলটা করে তা হলো নতুন দেখে একটা মোবাইল ফোন কিনবে বাংলাদেশ থেকে কারণ খুশিতে, বা আমেরিকায় মোবাইল ফোনের দাম ডলারে ইত্যাদি ইত্যাদি। এইটায় দুইটা সমস্যা।
১) আপনার ফোন আমেরিকায় কাজ নাও করতে পারে, কারণ ওদের নেটওয়ার্ক আর বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক এক রকম না।
২) ইন্টারন্যাশনাল ফোন কিনেও লাভ নাই, কারণ সেক্ষেত্রে আরেকটা সমস্যা হয়। ধরেন আমেরিকায় নেটওয়ার্কের ৪টা অংশ, A,B,C,D. আপনার ইন্ট্যারন্যাশনাল ফোন হয়তো নেটওয়ার্ক একসেস করতে পারবে খালি C,D,E,F। সেক্ষেত্রে যেহেতু C,D দুইটাতেই আছে, তাই সেই ইন্টারন্যাশনাল ফোন কাজ করবে। কিন্তু অর্ধেক স্পিডে, অর্ধেক নেটওয়ার্কে!
সুতরাং, এখানে এসেই মোবাইল ফোন কেনা ভালো। আর আসার পরে এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে ঠিক করবেন কোন নেটওয়ার্ক প্রোভাইডার নিবেন। এদের নেটওয়ার্ক আমাদের দেশের মতো সবখানে সবসময় জাতীয় না। কোন এলাকায় কোন নেটওয়ার্ক ভালো কাজ করবে সেটা ওখানের লোকজনের সাথে আলাপ করলেই ভালো। নেটওয়ার্ক কোম্পানির লোকের সাথে আলাপ করে লাভ নাই, কারণ ঠিক আপনার বাসার আশেপাশে নেটওয়ার্ক থাকবে নাকি সেটা ওদের জানার কথা না।
জামা জুতা সোয়েটার
আমেরিকায় আপনি যে এলাকায় যাচ্ছেন সেটার উপরে ভিত্তি করে অল্প কিছু কাপড় নিতে পারেন। বাংলাদেশ আর আমেরিকার আবহাওয়া এক না। ওদের কাপড় বেশিরভাগই তৈরি হয় Breathable হিসাবে, মানে ধরেন শীতকালে ঐ কাপড় পড়লে শীত লাগবে না, কিন্তু ঘামবেনও না। বাংলাদেশে আপনি কম দামে আপনাকে গরম রাখবে এমন অনেক কাপড় কিনে নিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু দিন শেষে ঐগুলো আপনাকে সিদ্ধ করে ফেলবে ঘামিয়ে, গরমে। সবমিলিয়ে আমার মতে জামা জুতো সোয়েটার যাই বলেন, আমেরিকার দোকান থেকে কেনা ভালো।
আর Thrift Shop বলে একটা জিনিষ আছে - অনেকেই কাপড় হোক বা আসবাবপত্র - পুরানো হয়ে গেলে এসব দোকানে দান করে দেয়। এসব দোকানে আবার খুব ভালো মতো এই দান করা জিনিষ পরিষ্কার করে অল্প দামে বিক্রি করে। অবশ্য নিয়মিত যাওয়া লাগে, কারণ এক এক সিজনে এক এক রকম জিনিষ দান করে মানুষ। তাতে তিনটা লাভ, পরিবেশ দূষন কমে, আর অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয় এসব দোকানে। আমেরিকান বা বিদেশি শিক্ষার্থীরা অনেকেই এসব দোকানে যায় কেনাকাটা করতে, আমিও খারাপ কিছু দেখি না এতে। এটা নিয়ে একটা বিখ্যাত গানও আছে, চাইলে শুনতে পারেন এখানে:
আপনার ধারণা খালি গরীবরা থ্রিফ্ট শপে যায়? Scott Hanselman এর নাম শুনেছেন? মাইক্রোসফটে ১৩ বছরের উপরে আছেন, প্রিন্সিপাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার, পার্টনার প্রোগ্রাম ম্যানেজার, প্রিন্সিপাল কমিউনিটি আর্কিটেক্ট ইত্যাদি পদ অলংকৃত করেছেন - উনিও কিন্তু নিয়মিত থ্রিফ্টিং করেন।
টেকাটুকার কালচারাল শক
আমেরিকায় আসার পরে আমি সহ অনেকেই দেখেছি এমনে চিন্তা করে, “হায় হায়, একটা খাতার দাম ১০ডলার, মানে ৮৩০ টাকা। খাইছে রে, গেছিরে, মরসিরে!” এই চিন্তা করে শুরুর দিকে আমি বাসায় যে ফ্রি বিজ্ঞাপনের কাগজ দেয় সেই কাগজের চিপায় চাপায় অংক কষতাম! এখানে আসার পরে টেবিল চেয়ার বিছানা বালিশ তোষক কিনেই তো ফতুর হয়ে গেছি, আমি তো শ্যাষ।
এক দেড় মাস পরেই মাথায় আসলো, যাহ বাব্বা, এমনে করলে তো টিকতে পারবো না। এরা টেকাটুকা দিচ্ছে যেন ভালো মতো খাওয়াদাওয়া করে পড়াশুনা করতে পারি। আর প্রথম দিকের খরচ তো এককালীন। মাসে মাসে তো আর বিছানা বালিশ কেনা লাগবে না। সুতরাং, প্রথম ৬ মাস ধরে নিলাম একটা ডলারও জমাতে পারবো না। যা যা দরকার, খাবার হোক আর কলম - সব কেনা শুরু করলাম।
বাঙ্গালি আমি বাংলাতেই থাকি
এটা আরেক সমস্যা। আমেরিকায় আসছেন, আমেরিকায় নানা দেশি মানুষ পাবেন, সবার সাথে বন্ধুত্ব করবেন। ঐ বাঙ্গালিদের খুঁজে তাদের মাঝেই থাকলে না জানবেন আমেরিকান সংষ্কৃতির ব্যাপারে, না বুঝবেন তাদেরকে। আর সেটা না করলে মুশকিল! কারণ আপনার প্রোগ্রামে, আপনার ল্যাবে আপনার সাথে যারা আসবে তাদের চেহারাই আগামী ৫-৬ বছর আপনার দেখা লাগবে। সব মিললে আপনার সারাজীবনের বন্ধুও হয়ে যেতে পারে যাদের সাথে আপনি ভবিষ্যতে গবেষণায় (বা চাকরিতে) কোলাবোরেট করতে পারবেন। আমার মতে, ক্লাস শুরু হবার পরে একটু বেশি কষ্ট করা উচিৎ অন্যদের সাথে পরিচিত হবার জন্য, কারণ প্রথম এক দুই সপ্তাহেই যা সার্কেল তৈরি হবার হয়ে যায়। এর পর নতুন করে পরিচিত হওয়া বা সার্কেল বানানো অনেক কঠিন।
এছাড়াও, আমেরিকার সাংষ্কৃতিক বিষয়ে বিষয়ে রাগিব হাসান স্যারের একটা খুব ভালো লেখা আছে, আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা - কালচারাল শক; পড়ে দেখতে পারেন।
ইমেইল নিয়মিত দেখা
আপনার সাথে যা যোগাযোগ করবে বিশ্ববিদ্যালয়, ধরে নিন সব ইমেইলে। Social Security Number (SSN - আমেরিকায় অর্থনৈতিক যেকোন কাজে লাগতে পারে) বানানো, ব্যাংক একাউন্ট, হেল্থ ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি সবকিছুতেই আপনাকে ইমেইল করবে। সেই ইমেইলগুলো উপর থেকে নিচে পড়ার দায়িত্ব আপনার। কাজেই ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে সব ইমেইল পড়বেন, আবারো বলছি, উপর থেকে নিচে। নাহলে কোন চিপায় চাপায় কোন একটা ডেডলাইন থাকবে যেটা আপনি দেখবেন না, তারপরে ফ্যাসাদে পড়বেন। আমি একজনের কথা শুনেছিলাম যে এরকম সময় মতো ইমেইল দেখেও না, পড়েও না - শেষপর্যন্ত SSN সময় মতো বানাতে পারেনি বলে মাসখানেক বেতন না পেয়ে বড় ভাইবোনদের থেকে ধারদেনা করে চলেছে। ঐ ধারদেনা করার উপায় না থাকলে বেচারা কী করতো কে জানে!
কোর্স সিলেবাস
বাংলাদেশে কী হয়েছে ভুলে যান, আমেরিকায় (অন্ততঃ ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে) প্রফেসররা ক্লাসের শুরুতেই একটা সিলেবাস দিয়ে দিবেন কোর্সের। সেটায় পরিষ্কার ভাবে লেখা থাকবে, কোর্সে আপনার দায়িত্ব কী, মার্কস কীভাবে বন্টন করা হয়েছে সহ অন্যান্য বিস্তারিত। সেটা ঠিক মতো না পড়লে আপনি ফ্যাসাদে পড়বেন। একজনের কাহিনী শুনেছিলাম ক্লাসে, প্রফেসর প্রোজেক্টের লিস্ট দিয়েছেন যেন সবাই যার যার প্রেফারেন্স অনুসারে সাজিয়ে ইমেইল করে। সেও ইমেইল করেছে, কিন্তু প্রফেসর তাকে দিয়েছে সবচেয়ে অপছন্দেরটা। বেচারা খেপে আগুন, প্রফেসর তাকে পছন্দ করে না, তাকে ভালো প্রোজেক্ট দেয় নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। ইমেইলও করলো প্রফেসরকে, আমাকে আরেকটা দেয়া যায় না? আমাকে তো সবচেয়ে অপছন্দেরটা দেয়া হয়েছে। প্রফেসরও সুন্দর মতো করে উত্তর দিলেন, কিন্তু সিলেবাসে তো বলাই ছিলো, যে যতো আগে ইমেইল করবে তারটা ততো বেশি গুরুত্ব পাবে প্রেফারেন্স এর হিসাবে। কোন সময় থেকে প্রেফারেন্স জানানো যাবে সেটাও নির্দিষ্ট করা ছিলো, কাজেই সবাই যথেষ্ট সময় পেয়েছে প্রেফারেন্স লিস্ট রেডি করার। বাকিরা তো সবাই অনেক আগেই জানিয়েছে, আর তুমি জানিয়েছো একদম ডেডলাইনের শেষ কয়েক মিনিটে!
সুতরাং, আঁই কী কইত্তাম? ¯\(ツ)/¯
ঠিকমতো আলাপ আর যোগাযোগ করা
এই জিনিষটা খালি আমেরিকায় না, বাংলাদেশসহ দুনিয়ার যেকোন যায়গায় সমস্যা তৈরি করে। ধরেন প্রফেসর আপনাকে কাজ দিয়েছে, আর আপনি সেই কাজটা করতে পারেন নাই। হয়তো সেটা শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতার কারণে। এখন আপনি কাজটা করেন নাই এজন্য প্রফেসর বকা দিবে - এই ভয়ে ঘাপটি মেরে ডুব দিলেন। সেক্ষেত্রে সমস্যা আরো বাড়বে। ডুবন্ত মানুষও তো খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করে, চুপচাপ ঘাঁপটি মেরে ডুবে যায় না।
আপনিও জানাবেন, প্রফেসর ভালো হলে আর আপনি যুক্তিযুক্ত কারণ দিলে প্রফেসর অবশ্যই সেটা সম্মান করবেন, সময় বেশি দিবেন, বা আপনার সমস্যার সমাধানের জন্য সাহায্য করবেন। আপনি তো কাজ করতে চান বলেই সমস্যার কথা আলাপ করবেন, কাজেই প্রফেসরেরও এ বিষয়ে আপত্তি থাকার কথা না।
ঝামেলা বাধে অন্যখানে। ধরেন আপনি ঝামেলায় পড়লেন, জানালেন না। সমস্যা বেড়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর পরে আপনি ভিকটিম বানালেন নিজেকে - সেক্ষেত্রে আপনাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না বা করতে চাইবে না। আর ১৮ এর পরে আপনাকে সবাই ধরে নিবে পরিপক্ক, সুতরাং খ্যাচম্যাচ করে, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লাভ নেই।
প্রফেসর খারাপ হলে অবশ্য অন্য কাহিনী, সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে আরেক লেখায় আলাপ করবো।
পাঠক বা পাঠিকা,
- আপনি আমেরিকায় ইতিমধ্যে এসেছেন: উপরের কোনটা আপনি আগে জানলে কি সুবিধা হতো বা সমস্যা থেকে বাঁচতেন? বা আরো কী জানলে আপনার সুবিধা হতো?
- আমেরিকায় আপনি ভবিষ্যতে আসবেন: উপরেরগুলো জেনে আশা করি উপকার হয়েছে। আরো কী জানলে সুবিধা হয়?
কমেন্টে জানান, আমার ভবিষ্যতে লিখতে সুবিধেও হবে, উৎসাহও পাবো। আপাততঃ এটুকুই :)
লগইন ছাড়াই কমেন্ট করতে নাম এ ক্লিক করুন, দেখবেন তার নিচেই আছে অতিথি হিসাবে কমেন্ট করার অপশন।